রকিবুল হক
দফায় দফায় আলোচনা ও অনুরোধের প্রেক্ষিতে হরতাল স্থগিত করার এক দিনের মাথায় সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের দাবি-দাওয়ার অধিকাংশই অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। গতকাল তিনি বলেন, ওলামা পরিষদের দাবি পূরণের কোনো আশ্বাস দেইনি। তাদের দাবি নিয়ে আলোচনার কথা বলেছি। অপরদিকে এইচটি ইমামের এই বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ওলামা পরিষদ নেতারা। তারা বলেন, দাবি পূরণের ব্যাপারে উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে কসম করেছেন। তার ওয়াদা এবং অনুরোধ অনুযায়ী হরতাল স্থগিত করা হয়েছে। এখন অস্বীকার করলে তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক। তার এই বক্তব্যের বিষয়ে ওলামা পরিষদের পক্ষ থেকে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। অপরদিকে হরতাল স্থগিত করা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ওলামা পরিষদ।
সূত্রমতে, সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস হওয়া জাতীয় শিক্ষানীতিকে ধর্মহীন আখ্যায়িত করে এটি সংশোধন, ইমামদের অনুষ্ঠানে মার্কিন তরুণ-তরুণীদের নিয়ে অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শনের অভিযোগে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজির অপসারণ এবং ’৭২ সালের সংবিধানে ফেরার নামে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র বন্ধসহ বিভিন্ন দাবিতে ৮ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ২৬ ডিসেম্বর সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ। এ ঘোষণার পর থেকেই হরতাল প্রত্যাহার করাতে ওলামাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন সরকারের প্রতিনিধিরা। এর অংশ হিসেবেই প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সঙ্গে ওলামাদের ৩ দফা বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে তাদের দাবি-দাওয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস প্রদান করা হয়। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর রাতে এইচটি ইমামের বাসায় ওলামাদের বৈঠকে দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়। এ প্রেক্ষিতেই শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হরতাল স্থগিত করার ঘোষণা দেয় ওলামা পরিষদ। ওই সংবাদ সম্মেলনে পরিষদ নেতা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন ভালোভাবে উদযাপন এবং দাবি-দাওয়া পূরণের ব্যাপারে সরকারের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তাদের অনুরোধেই হরতাল স্থগিত করা হয়। তবে এক মাসের মধ্যে এসব দাবি না মানা হলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে পরিষদ।
এদিকে ওলামা পরিষদের এই ঘোষণার এক দিনের মাথায় গতকাল একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে সাক্ষাত্কারে প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ওলামাদের ঘোষণাকে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের দাবি-দাওয়ার অধিকাংশই অযৌক্তিক। দু-একটি প্রস্তাবনা গ্রহণযোগ্য। এগুলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের ডাকা রোববারের হরতালে একটি রাজনৈতিক দলের ইন্ধন ছিল। অকারণে তারা সমর্থন দিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চেষ্টা করছিল। তা আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেছি। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে গৃহীত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর মূল স্তম্ভ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। এই শিক্ষানীতি জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। এটি গ্রহণযোগ্য নীতি নয় বললেই তো আর পরিবর্তন করা যায় না।
সরকারের আশ্বাসে ২৬ ডিসেম্বর ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের ডাকা হরতাল স্থগিত করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করার বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ওরকম কোনো আশ্বাসের কথা বলিনি। বলেছি, তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করা হবে। তিনি বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। এটা নিয়ে কেবিনেটে, সংসদে আলোচনা হবে। তারপর ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করব। ইফার ডিজিকে অপসারণ করা হবে কিনা জানতে চাইলে এইচটি ইমাম বলেন, তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেব। উল্লেখ্য, হরতালকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ব্যাপক নাশকতা হতে পারে, গোয়েন্দাদের এমন রিপোর্টের প্রেক্ষিতে ৭ ডিসেম্বর থেকেই এই হরতাল প্রত্যাহার করাতে সরকার নানা রকম চেষ্টা শুরু করে।
এদিকে এইচটি ইমামের এই বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, এইচটি ইমামের বক্তব্য সম্পর্কে আজ আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়া হবে। তবে তিনি বলেছেন, উপদেষ্টা শিক্ষানীতির মৌলিক বিষয় সংশোধনে আলাপ-আলোচনার কথা বলেছেন। তার কথার ভিত্তিতেই হরতাল প্রত্যাহার করেছি। এখন যদি তিনি অস্বীকার করেন তাহলে তা দুঃখজনক এবং রাজনৈতিক অসাধুতা হিসেবে গণ্য হবে। তার মতো একজন দায়িত্বশীল এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনার পর দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে এখন অস্বীকার করার ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি বলেন, এ বিষয়ে প্রেসনোট দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। তবে ওলামাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকার কাজ করবে বলে তিনি আশা করেন।
এ বিষয়ে ওলামা পরিষদের জয়েন্ট সেক্রেটারি ড. খলিলুর রহমান মাদানী বলেন, এইচটি ইমাম দাবি পূরণের ব্যাপারে ৩ বার কসম করেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘পর্যায়ক্রমে শিক্ষানীতি সংশোধন করা হবে। ইফা ডিজির অপসারণ বিষয়েও পদক্ষেপ নেয়া হবে। এসব বিষয়ে এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আপনারা হরতাল প্রত্যাহার করেন, সঙ্গে সঙ্গেই পদক্ষেপ নেয়া হবে।’ তিনি বলেন, আমাদের দাবির বিষয়ে সরকারিভাবে একটি ঘোষণা দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। রোববারের মধ্যে কোনো ঘোষণা না এলে আজ পরিষদের বৈঠকের মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও ড. মাদানী জানান।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ : এদিকে জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে হরতাল স্থগিত করেছে মর্মে প্রদত্ত আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ। এ বিষয়ে গতকাল পরিষদের সভাপতি মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় বলা হয়, এতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহর সঙ্গে হরতাল আহ্বান এবং স্থগিত সম্পর্কিত সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ নেতাদের আলোচনা সম্পর্কে আইনমন্ত্রীর নিদারুণ অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
সভায় আরও বলা হয়, পরিষদ নেতারা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠককালে পরিষদের দৃষ্টিতে জাতীয় শিক্ষানীতির ত্রুটি-বিচ্যুতি পেশ করা হয়। তারা পরিষদ নেতাদের বক্তব্য অত্যন্ত ধৈর্যসহ শোনেন এবং কোনো বাধ্যবাধকতা বা শর্তারোপ করেননি। জাতীয় শিক্ষানীতির ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণার্থে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস প্রদানের প্রেক্ষিতে সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ তাদের হরতাল স্থগিত ঘোষণা করে। আইনমন্ত্রী ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানের ভাষায় শিক্ষানীতি সম্পর্কে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে পরিষদ হরতাল স্থগিত করেনি—হরতাল স্থগিত করা সম্পর্কে তাদের বক্তব্য জনমনে বিভ্রান্তির বেড়াজাল সৃষ্টি করে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের এক সূক্ষ্ম কৌশল বৈ আর কিছুই নয়।
তারা বলেন, শিক্ষানীতির সংশোধন ও ইফার বিতর্কিত ডিজির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রশ্নে আমরা আমাদের দাবিতে অটল আছি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যদি সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদ হরতালের পাশাপাশি যে কোনো বড় ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করলে উদ্ভূত ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য সরকারকেই দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে
।
No comments:
Post a Comment