রেজাউল হক কৌশিক
প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যেই বিরাজ করছে অস্থিরতা। কিছুতেই নামানো যাচ্ছে না দ্রব্যমূ-ল্যের ঊর্ধ্বগতি। সরকারের বারবার হুশিয়ারি সত্ত্বেও দাম কমার পরিবর্তে প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে। ভরা মৌসুমেও দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম বেড়েই চলেছে। সরকারিভাবে পরিকল্পিত বাজার মনিটরিং না থাকা, কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি, ধান-চাল মজুত এবং আমদানি না থাকাকে দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারে একজন অন্যজনের ওপর দোষ চাপালেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার। এতে উচ্চ আয়ের মানুষের তেমন সমস্যা না হলেও হিমশিম খাচ্ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। গত সপ্তাহের তুলনায় চাল, আটা, ময়দা, ছোলা, রসুন, সয়াবিন ও পামঅয়েলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
এখন আমনের ভরা মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও না কমে প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে চালের দাম। উত্পাদন, পর্যাপ্ত মজুত এবং সারাদেশে ওএমএসের মাধ্যমে সরকার চাল বিক্রি শুরু করলেও বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়ছে না। বাজারে নতুন চাল উঠলে পুরান চালের দাম কমার প্রবণতা স্বাভাবিক নিয়ম হলেও এ বছর তার ব্যতিক্রম কেন হচ্ছে এর সঠিক ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারছে না। একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। চালসহ কোনো দ্রব্যমূল্যের ওপরই নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের।
মিলারদের অতিরিক্ত ধান-চাল মজুত, পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণ সুবিধা, গুদামে ধান-চাল আটকে রেখে অতি মুনাফা করার প্রবণতা ইত্যাদির কারণে চালের দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দাম বাড়ার বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য সরকার আগামী সপ্তাহে একটি কমিটি করবে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়াও চলতি মাসেই মজুতবিরোধী আইন হবে বলে জানা গেছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মিনিকেট চাল পাইকারি ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা, খুচরা ৪৮ থেকে ৫০ টাকা; পাইজাম পাইকারি ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা, খুচরা ৪০ থেকে ৪২ টাকা; লতা পাইকারি ৪০ থেকে ৪৪ টাকা, খুচরা ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা; পারি পাইকারি ৪০ থেকে ৪২ টাকা, খুচরা ৪৩ থেকে ৪৪ টাকা; নাজির পাইকারি ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা, খুচরা ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা; স্বর্ণা পাইকারি ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা, খুচরা ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা; হাসকি পাইকারি ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা, খুচরা ৩৮ থেকে ৩৯ টাকা, মোটা চাল পাইকারি ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা, খুচরা ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা দরে বিক্রি হয়। ঠিক এক বছর আগে এই চালের দাম ছিল কেজিপ্রতি ২৬ থেকে ২৮ টাকা। টিসিবি’র তথ্য মতে, গত এক বছরে শুধু মোটা চালের দামই বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবেও এক বছরে চালের গড় দাম বৃদ্ধি ২৪ শতাংশ।
চালের আড়তদাররা বলছেন, চালকলগুলো বিপুল পরিমাণ চাল গুদামজাত করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়াচ্ছে। আর চাতাল ও মিল মালিকরা বলছেন, আড়তদার ও পাইকাররা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে চালের দাম বাড়াচ্ছে। এভাবে একে অপরের ওপর দোষ চাপালেও সরকারিভাবে বাজারে মজুত তদারকি এবং সমগ্র বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর নিয়মিত মনিটরিং না থাকায় এভাবে চালের দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কোন মিলের কত মজুত, ধান থেকে চাল করা এবং সেই চালের কত পরিমাণ বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে তার কোনো হিসাব সরকারের কাছে নেই।
এদিকে চালের সঙ্গে আটা ময়দার দামও বেড়েছে। প্যাকেট আটা ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা, খোলা আটা ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা, প্যাকেট ময়দা ৩৯ থেকে ৪০ টাকা, খোলা ময়দা ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। গত এক সপ্তাহের তুলনায় প্রতি কেজি আটায় বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা এবং এক মাসের তুলনায় বেড়েছে ছয় থেকে সাত টাকা।
চাল ও আটা ছাড়াও এ সপ্তাহে বেড়েছে সয়াবিন তেল, ডাল, চিনি ও তরিতরকারির দাম। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি নতুন দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকায়। মশুর ডাল মানভেদে ১০০ থেকে ১১৪ টাকা। রসুন দেশি ভালোটা ১৯০ থেকে ২০০ টাকা এবং সাধারণ মানের ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি । শুকনা মরিচ ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা, প্রতি কেজি গুঁড়া হলুদ বিক্রি হয়েছে ৩১০ থেকে ৩২০ টাকা, ছোলা ৪৫ টাকা। প্রতিকেজি পুরাতন আদা বিক্রি হয়েছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় এবং নতুন আদা ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। জিরা প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, এলাচ ২ হাজার ৯০০ টাকা, মোটাদানার এলাচ ৩ হাজার টাকা, দারুচিনি ২২০ টাকা, প্রতি কেজি চিনি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, কেজিপ্রতি লবণ ২০ টাকা, প্রতি হালি মুরগির ডিম বিক্রি হয়েছে ২২ থেকে ২৪ টাকা।
এদিকে শীত মৌসুম হওয়ার পরও সবজির দাম কম নয়। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে দেখা গেছে, মানভেদে প্রতি কেজি বেগুন (গোল) বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। আলু ১৩ থেকে ১৫ টাকা, কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, ফুলকপি প্রতিটি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, পাতাকপি ২০ থেকে ২৫ টাকা, পেঁপে ১০ থেকে ১২ টাকা, শসা ২৪ থেকে ২৫ টাকা, শিম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, মুলা ১৬ থেকে ১৮ টাকা। এছাড়া টমেটো ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, করলা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, বরবটি ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, ঢেঁড়স ৪২ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহের তুলনায় প্রায় প্রতিটি সবজির দাম বেড়েছে।
এদিকে মাছ গোশতের বাজারও রয়েছে চড়া। গোশতের মধ্যে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১১০ থেকে ১২৫ টাকা, দেশি মুরগি প্রতি পিস ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, গরুর গোশত ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা ও খাসির গোশত ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়। মাছের মধ্যে রুই প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা, ইলিশ প্রতি কেজি ৪৭৫ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এদিকে অন্যান্য দ্রব্যের মতো দাম বেড়েছে খোলা সয়াবিন ও পামঅয়েলের। সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে গত সপ্তাহের তুলনায় গতকাল খুচরা বাজারে প্রতি কেজি সয়াবিনে ১ থেকে ২ টাকা বেড়ে ৯৮ টাকা এবং পামঅয়েল ৮৮ টাকা কেজি নির্ধারিত থাকলেও বিক্রি হয়েছে আরও বেশি দামে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন বিক্রি হতে দেখা গেছে ১০০ টাকা দরে। আর পাম সুপার তেল ৯৩ টাকা লিটার দরে। রাজধানীর মৌলভীবাজারের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী মো. আলী ভুট্টো জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেশি। আর দেশে ভোজ্যতেলের বাজার পুরোপুরিই আমদানিনির্ভর। তাই বিশ্ববাজারে দাম না কমলে দেশীয় বাজারে দাম কমার সম্ভাবনা কম।
বোতলজাত তেলের মধ্যে পাঁচ লিটারের বোতল ৫০৫ থেকে ৫১০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। এক লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ১০২ থেকে ১০৪ টাকা দরে। রূপচাঁদা, তীর, ফ্রেশ, মুসকান, পুষ্টিসহ প্রায় সব কোম্পানির তেলের দামই এক দেখা গেছে।
এগুলো ছাড়াও গত মাসের তুলনায় প্যাকেটজাত ডানো গুঁড়ো দুধ প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫৫ থেকে ৪৭০ টাকায়, ডিপ্লোমা (নিউজিল্যান্ড) একইভাবে বেড়ে একই দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্যাকেটজাত ফ্রেশ ও মার্কস গুঁড়ো দুধ গত মাসের তুলনায় ১০ টাকা বেড়ে গতকাল বিক্রি হয়েছে ৩৯০ থেকে ৪০০ টাকায়।