Sunday 27 March 2011

বরিশালে ক্রেতাদের ক্ষোভ : বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার মাসুল সরকারকে দিতে হবে

=জি. এম. বাবর আলী, বরিশাল

কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না বাজার দর। ক্রমান্বয়েই দাম বাড়ছে প্রায় সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের। ৮/১০ দিনের ব্যবধানে বাজারে পেঁয়াজ আলুর মতো ২/১টি ছোটখাট পণ্যের দাম কিছুটা কমলেও চাল, ভোজ্য তেল, দুধ ও চিনিসহ দাম বেড়েছে বেশিরভাগ পণ্যের। অব্যাহত দ্রব্যমূল্যের জন্য কেউ কেউ মধ্যস্বত্বভোগী, কেউ কেউ সিন্ডিকেটকে দায়ী করলেও অধিকাংশ ক্রেতার মতে সরকারিভাবে সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবেই বাজারে ইচ্ছামাফিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও মাথাব্যথা নেই সংশ্লিষ্ট দফতর ও কর্মকর্তাদের। অব্যাহত এ দ্রব্যমূল্য
বৃদ্ধির ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে আছে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। নগরীর বড় বাজার, নতুন বাজার ও বটতলা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়েছে। যেমন দামে কেনা হচ্ছে তেমন দামেই বিক্রি করছেন বলে দাবি বিক্রেতাদের। এছাড়া পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির আর কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না বেশিরভাগ বিক্রেতা। তবে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই মূল্যবৃদ্ধির জন্য বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করলেন। বাজার রোডের মাতৃভাণ্ডার নামের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বলাই সাহা আমার দেশকে বলেন, মিল মালিকদের ইচ্ছামাফিক মূল্য নির্ধারণের ফলে তেলের বাজারে অস্থিরতা চলছে। সিন্ডিকেটও মূল্যবৃদ্ধির জন্য অনেকটা দায়ী। বাজার মনিটরিংয়ের বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, একদিনও চোখে পড়েনি মনিটরিং ব্যবস্থা।
নগরীর আবদুর রব নামের এক রিকশাচালক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রোজ রোজ সব জিনিসের দাম বাড়ছে। ফলে আয় করা টাকা দিয়ে ৭ জনের পরিবার নিয়ে নানা কষ্টে চলছে তার সংসার। তিনি বলেন, প্রতিদিনই বিক্রেতারা ইচ্ছামত দাম বাড়ালেও কেউ কিছুই বলছে না। অথচ যাত্রী পরিবহনে ৮ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকার আবেদন করলেই তাদের ভাগ্যে জোটে অশ্লীল ভাষার গালিগালাজ ও চড়-থাপ্পর।
একটি এনজিওতে কর্মরত মোতালেব বিশ্বাস নামের অপর এক ক্রেতা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলেও বাড়ছে না তাদের বেতন-ভাতা। ফলে চরম দুর্ভোগের মধ্য দিয়েই চলতে হচ্ছে তার মতো নিম্ন আয়ের মানুষকে। তিনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য সরকারকে দায়ী করে বলেন, রহস্যজনক কারণে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। আর বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের এহেন গাফিলতি আর ব্যর্থতার মাশুল সরকারকেই দিতে হবে।
বরিশালের বিভিন্ন বাজারে ৭ দিন আগের ৫০ টাকার মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা কেজি দরে। আর সর্বনিম্ন ৩৫ টাকা কেজির বুলেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকা কেজি দরে। এছাড়া ৩৬ টাকার স্বর্ণা ৩৮ টাকা, ৪১ টাকার বাঁশফুল ৪৩ টাকা, ৪৪ টাকার আঠাশ বালাম ৪৫ টাকা এবং ৩৯ টাকার মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। একইভাবে আটা ও ময়দার দামও বেড়েছে কেজিপ্রতি ১/২ টাকা। বিভিন্ন ধরনের ময়দা ৪০ টাকা এবং আটা ৩৫ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
চালের মতো চিনি আর ভোজ্য তেলের দামও বেড়েছে। বাজারে ৬০ টাকা কেজি দরের চিনি ৬৪ টাকা হয়েছে। হঠাত্ করে এ মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারেননি বিক্রেতারা। একমাস ধরে বরিশালের তেলের বাজারে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির সংবাদ বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত হলেও মাথাব্যথা নেই কর্তাব্যক্তিদের। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ৯০ টাকার ১ লিটার তেলের দাম ১২০ টাকায় এসে পৌঁছেছে। ৭ দিন আগে যা বিক্রি হয়েছে ১১৫ টাকায়। ৮/১০ দিনের ব্যবধানে ৯৮ টাকার পামঅয়েল বিক্রি হচ্ছে ১০৪ টাকায়। একইভাবে দাম বেড়েছে বোতলজাত সয়াবিনেরও। মাত্র ১০ দিন আগে তীরমার্কা ৫ লিটার তেলের মূল্য ছিল ৫০৫ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৭০ টাকায়। ৫শ’ টাকার রূপচাঁদা ৫৭০ টাকা, ৪৯৫ টাকার মুশকান ৫৫৫ টাকা এবং ৪৯৮ টাকার দাদা ৫৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব তেলের অনেক বোতলের গায়ে আগের দাম লেখা থাকলেও বর্ধিত মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে।
বাজারে দাম বেড়েছে সব ধরনের দুধের। এক্ষেত্রেও বিক্রেতাদের যুক্তি একটাই, অতিরিক্ত দামে ক্রয় করায় অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হচ্ছে। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবধরনের দুধের প্যাকেটের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে ৫শ’ গ্রামের ২০৫ টাকার ফ্রেশ দুধ বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা, একইভাবে ২১৮ টাকার ডানো ২৩৫ টাকা, ২০৫ টাকার মার্কস ২২০ টাকা, ২২৭ টাকার ডিপ্লোমা ২৪৫ টাকা এবং ১ কেজির ৩৭০ টাকার প্রাণ দুধ বিক্রি হচ্ছে ৪১০ টাকায়। ৫শ’ গ্রামের লিকুইড দুধের প্যাকেট ৩০ টাকা থেকে মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ৩২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে কেজিপ্রতি আলুর দাম ২ টাকা কমে ৬ টাকা এবং ৩০ টাকার পেঁয়াজ ২৫/২৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মসুরির ঢালের দামও কমেছে কেজিপ্রতি ২ টাকা। ৯০ টাকার ডাল বিক্রি হচ্ছে ৮৮ টাকায়। কিন্তু হলুদ, মরিচসহ শাকসবজি এবং তরি-তরকারির দাম বেড়েছে। ১৮০ টাকা দামের মরিচ ২০০ টাকা এবং ২৮০ টাকা কেজির হলুদ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। বাজারে প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি ও তরিতরকারি থাকলেও দাম কমছে না কোনোটিরই। কয়েকদিন ধরে প্রায় সবধরনের তরকারির দাম বেড়েছে। বিভিন্ন বাজারে বিভিন্ন দরে বিক্রি হচ্ছে এসব শাকসবজি ও তরকারি। ৮ টাকার সিম বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। টমেটো ২০ টাকা, খিরাই বা শসা ৩০ টাকা, শালগম ১০ টাকা, গাজর ১৬ টাকা, মাঝারি সাইজের একটি লাউ ৩০ থেকে ৪০ টাকা, দুটি লাউয়ের ডগা ১০ থেকে ১৫ টাকা, পুঁইশাক ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বরিশালের বড় বাজারে ব্রয়লার ও কক মুরগি ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও দেশি মুরগির দাম ছিল ২৫০ টাকা কেজি। সাড়ে ৪শ’ টাকা কেজির খাসির মাংস ও ২৬০ টাকা কেজির গরুুর মাংসের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। ফার্মের মুরগির ডিম ১১০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিম ১৩০ টাকা কুড়ি দরে বিক্রি হচ্ছে।

দাম বৃদ্ধি : ওএমএস’র চাল সঙ্কট : মাগুরার মহম্মদপুরে অভাবী মানুষের হাহাকার বাড়ছে

মহম্মদপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি

মহম্মদপুরে ওএমএসের চাল না পেয়ে প্রতিদিন ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই। চাল না পেয়ে মহম্মদপুরে বেড়ে যাচ্ছে অভাবী মানুষের হাহাকার।
তখন সকাল ৭টা। ওএমএসের চাল দেয়া শুরু হতে আরও দু’ঘণ্টা বাকি। ডিলার দোকান খোলেননি। চাল নিতে শুরু হয়ে গেছে লাইনে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতা। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই দীর্ঘ হচ্ছে অভাবী মানুষের মিছিল। বাড়ছে হৈচৈ-চেঁচামেচি। ঘড়ির কাঁটায় ৯টা। দোকান খুলতে লাইনে দাঁড়ানো শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ চালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। চাল দিতে গলদঘর্ম হচ্ছিল দোকানের লোকজন। ১১টা বাজতেই খবর এলো আজকের বরাদ্দের চাল শেষ। তখনও চালের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ। এর মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশি। ডিলার বেচারা পালিয়ে বাঁচলেন। শুরু হলো চালের জন্য হাহাকার। এ চিত্র নিত্যদিনের। মহম্মদপুর উপজেলা সদরের খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রির সময় সব ডিলারের দোকানের সামনে এ দৃশ্য দেখা যায়। গরিব-অসহায় লোকজনের প্রধান খাবার মোটা চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ এবং ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। একটু কম দামে চাল সংগ্রহের এমন দৃশ্য এখন জেলার সর্বত্রই দেখা যায়। খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, জেলার প্রতিটি উপজেলায় প্রথমে পাঁচজন, পরে দুজন বাড়িয়ে সাতজন করে ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে উপজেলা সদরে চারজন এবং উপজেলা সদরের বাইরে বড়বাজারে তিনজন। সারা জেলায় মোট ৩১ জন ডিলার সপ্তাহে মঙ্গল ও শুক্রবার বাদে পাঁচদিন এক মেট্রিক টন করে চাল বিক্রি করছেন। একজন ডিলার দিনে ৫ কেজি করে সর্বোচ্চ ২০০ জনকে চাল দিতে পারছেন।
জানা গেছে, খোলাবাজারে বিক্রয় কেন্দ্রে যে চাল ২৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, বাজারে তার দাম ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা। বৃদ্ধ আবুল হোসেন বলেন, ফজরের নামাজ পড়ে লাইনে দাঁড়াই। পরে এসে দাঁড়ালে সেদিন আর চাল পাই না। তখন না খেয়ে থাকতে হয়। বোরকা পরে অনেক মহিলা চাল নিতে এসেছেন। তাদের একজন পরিচয় না দিয়ে বলেন, কখনও এভাবে চাল নিতে আসিনি। এখন নিরুপায় হয়ে আসতে হচ্ছে। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ানো বৃদ্ধা ফুলজান বেগম জানান, গায়ে বল নেই। ছেলেবউরা কাজে যায় আর আমাকে পাঠায় চাল আনতে। স্কুলড্রেস পরা শিশু আলম রায়পাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। সে জানায়, লাইনে আগে দাঁড়াতে পারলে স্কুল ধরতে পারি, না হলে পারি না। সরেজমিনে উপজেলা সদর, নহাটা, বাবুখালী, রাজাপুর, বালিদিয়া, বিনোদপুর, দিঘা ও পলাশবাড়ীয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন হাটবাজার ঘুরে দেখা গেছে, চালের দাম জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলকেও ছাড়িয়ে গেছে। মোটা চালের প্রধান ক্রেতা গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষ। মোটা চাল এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৩৫-৩৮ টাকা। চিকন চালের দামও কেজিপ্রতি বেড়েছে ৭-১০ টাকা। চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারাদেশে ওএমএস চালু করা হলেও এর তেমন কোনো প্রভাব বাজারে পড়ছে না।