কাদের গনি চৌধুরী
প্রশাসন চলছে ঢিমেতালে। বার বার আদেশ জারি করেও সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে মনোযোগী করা যাচ্ছে না। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারি কাজে গতি আসছে না দেখে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বার বার তাগিদ দেয়া হয়। কেবিনেট সেক্রেটারি ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্রও জারি করা হয়। এর পরও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সরকারের বিভিন্ন মহলে আলাপ করে জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সৃষ্ট আতঙ্ক, মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্য নতুন হওয়ায়, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় না থাকায়, মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে দ্বন্দ্ব, দক্ষ কর্মকর্তাদের ওএসডি করে কর্মহীন বসিয়ে রাখা, দলীয় বিবেচনায় অযোগ্যদের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন, জুনিয়রদের পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়রদের পদে বসানোর কারণে প্রশাসনে অসন্তোষ তৈরি হওয়ায় কাজকর্মে গতি আসছে না। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, কট্টর সরকারসমর্থক অফিসাররাও মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে না। তারা সরকারি কাজের চেয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। দিনের প্রথমভাগ তারা ব্যয় করেন শেয়ার ব্যবসা নিয়ে। যার ফলে কাজে গতি আসছে না।
সরকারি কাজে গতি না আসায় প্রধানমন্ত্রীর দফতরও অসন্তুষ্ট বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক এবং এর আগে জাতীয় সংসদের বাজেট বক্তৃতায় প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, সরকারে বয়স দুই বছর পার হলেও এখনও উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় নেই। সব সিদ্ধান্তের জন্য সবাই তাকিয়ে থাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দিকে। সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বেশিরভাগ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর অনভিজ্ঞতার কারণে মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি আসছে না। এছাড়া প্রশাসনিক অস্থিরতা ও ভীতিও রয়েছে। ফাইল সই করতে সবাই ভয় পায়। সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কেউ কেউ কোনো বিষয়ে একা সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন হলে মন্ত্রী সচিবের ওপর চাপিয়ে দেন, আবার সচিব এতে রাজি না হলে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হচ্ছেন। গত দু’বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি অনেক আমলাও গ্রেফতার হয়েছেন। তাই ভবিষ্যতের আতঙ্কে সচিব থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করছেন।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের ধীরগতি দেখে প্রতিটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের কাজের গতি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারি কাজে গতি বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবকে এ ব্যাপারে চিঠিও দেন। ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, নতুন গণতান্ত্রিক সরকার গণমুখী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও মন্ত্রণালয়গুলো তা যথাযথভাবে দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করছে না। এর ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে, সমস্যা সমাধানে এবং যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে অহেতুক বিলম্ব হচ্ছে। সেখানে আরও বলা হয়, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অহেতুক বিলম্ব ঘটায় তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
সূত্র জানায়, প্রশাসনিক এ ধীরগতির কারণে সেবাপ্রার্থীদের পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা অনভিজ্ঞ হওয়ায় এ সুযোগ গ্রহণ করছেন সচিবালয় কর্মকর্তারা। ফাইল নিষমত্তির ক্ষেত্রে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বও এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন এ কর্মকর্তারা। সেবাপ্রার্থীকে ফাইলের পেছনে না ছুটলে কাজ হয় না। তদবির না করলে হয় ফাইল থেমে যায়, নতুবা ফাইল গায়েব করে দেয়া হয়। অনেক সময় কোনো অজুহাত না পেলে ফাইল থেকে জরুরি কাগজ সরিয়ে ফেলা হয়। অধিদফতর কিংবা দফতরে নিষমত্তিযোগ্য ফাইল মন্ত্রণালয়ে চলে এলে ভোগান্তির মাত্রা আরও বাড়ে। মন্ত্রী এবং সচিবের মধ্যে বিরোধের কারণেও সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, সমস্যার সমাধান এবং যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে বিলম্ব হচ্ছে। বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে বিরোধের কারণে দীর্ঘদিন এখানে ঠিকমতো কাজ হয়নি। অবশ্য মাসখানেক আগে সচিব শফিক আলম মেহেদীকে বদলি করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনকে গতিশীল করতে নির্দেশনা দেয়া হয় যে, শাখা প্রধানরা ৭২ ঘণ্টা, উপ-সচিবরা ৪৮ ঘণ্টা এবং তদূর্ধ্ব পর্যায়ে ২৪ ঘণ্টায় ফাইল নিষমত্তি হতে হবে। কিন্তু এসব নিয়ম-কানুন মেনে ফাইল নিষমত্তি হচ্ছে না।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কাজের ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তাদের অনীহার বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, অনিষমন্ন কাজের তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আনা হচ্ছে না। তবে হাতেগোনা কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের নিয়মে কাজ করে যাচ্ছে সঠিক সময়ে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পদোন্নতি ও পোস্টিংবঞ্চিত কর্মকর্তাদের আলোচনা-সমালোচনা করে দিন কাটাতে। সম্প্রতি সরকার যুগ্ম সচিব পদে বড় ধরনের পদোন্নতি দেয়। তা সত্ত্বেও বঞ্চিতদের সংখ্যা এখনও বেশি। যারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তারা এখনও পোস্টিং পাননি। ফলে তাদের আগের জায়গায় কাজ করার ব্যাপারে বেশ কিছুটা অনীহা রয়েছে। তবে কোনো কোনো কর্মকর্তা নিজের তাগিদে আগের স্থানে কাজ করলেও মন নেই কাজে।
গত বছরের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব এক চিঠিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফাইল নিষমত্তি করতে সকল সচিবকে লিখিত নির্দেশ দেন। এতে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফাইল নিষমত্তি না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রিপরিষদের এই নির্দেশের পরও সচিবালয়ে নির্দেশিকা মানা হচ্ছে না ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনে পরিচালিত বিভিন্ন অধিদফতর ও বোর্ডে ফাইলের স্তূপ জমছে। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অভিযোগ, আবেদন ও অন্যান্য সমস্যা মাসের পর মাস এমনকি বছরেও সুরাহা হচ্ছে না। শিক্ষক-কর্মচারীদের সমস্যা দেখভালের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) ও কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরে কোনো মনিটরিং সেল নেই। সূত্র জানায়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, শিক্ষক-কর্মচারীদের পদোন্নতি, বদলি, টাইমস্কেল, এমপিওভুক্তি’র আবেদনসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিদিন প্রায় তিন শতাধিক আবেদন ও অভিযোগ নথিভুক্ত হচ্ছে; কিন্তু সাধারণ আবেদন, তদবির ও অভিযোগ দ্রুত সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠানো হয় না। প্রভাবশালীদের অনৈতিক তদবির, অভিযোগ ও ফরমায়েশি কাজ নিষমত্তি করতেই মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়।
সরজমিনে মাউশি’তে ঘুরে দেখা যায়, মহাপরিচালক ও পরিচালক ছাড়া বিভিন্ন দফতরে ফাইলের স্তূপ জমে আছে। ফাইল গতিশীল করার জন্য শত শত শিক্ষক প্রতিদিন মাউশিতে আসছেন। জমে থাকা ফাইল নিষমত্তির বিষয়ে সংস্থার মহাপরিচালক এবং স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা শাখার পরিচালকরা নিয়মিত সংশ্লিষ্টদের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলেও কার্যক্রম এগুচ্ছে না। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়েও একই অবস্থা বিরাজ করছে। মন্ত্রী-সচিব-সংসদীয় কমিটির বিরোধের কারণে দীর্ঘ দিন ধরে এ মন্ত্রণালয়ের কাজে কোনো গতি ছিল না। গত মাসে সচিবকে সরিয়ে দেয়ার পর কাজে কিছুটা গতি এসেছে বলে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি না থাকায় গত ৫ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ওই বৈঠকে তিনি দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সার্বিক অর্থনীতির অবস্থা মন্ত্রিসভাকে জানাতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। বৈঠকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদের হার বৃদ্ধি, রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়া, তারল্য নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে বলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জানান।
এ বৈঠকের পর পরই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অর্থ মন্ত্রণালয়ের সব ক’টি অনুবিভাগ/অধিশাখা/শাখায় চিঠি দিয়ে সমন্বয়কারী কর্মকর্তাদের আরও প্রো-অ্যাক্টিভ ভূমিকা রেখে শাখার কাজের সুষ্ঠু ও কার্যকর সমন্বয় সাধন নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনে গতি আনতে তৃণমূল পর্যন্ত ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে ‘লেস পেপার অফিস’ প্রতিষ্ঠা, ডিজিটাল স্বাক্ষর চালু এবং ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে কেনাকাটার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং মন্ত্রী-সচিবদের সঙ্গে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পর্যন্ত একটি চেইন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয় থেকে একেবারে উপজেলা প্রশাসন পর্যন্ত সরকারি নির্দেশনার ক্ষেত্রে ই-মেইল ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা দেয়া হলে ডিসি এবং ইউএনওরা যাতে একসঙ্গে সবাই পেয়ে যান, সে উদ্দেশ্যে এসব অফিসের জন্য ই-মেইল অ্যাকাউন্টও খুলে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া ডিজিটাল স্বাক্ষর চালু হলে এসব নির্দেশনার নির্ভরযোগ্যতা অনেক বাড়বে। আর মুহূর্তেই অফিসিয়াল নির্দেশনা পৌঁছে যাওয়ার কারণে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও হবে দ্রুত। এক্ষেত্রে ডিসি এবং ইউএনওদের প্রশিক্ষিত করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালy.