Sunday 1 January 2012

শুধু প্রতিশ্রুতি উন্নয়ন নেই






আলাউদ্দিন আরিফ
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তিন বছরের শাসনামলে সারাদেশে উল্লেখ করার মতো কোনো উন্নয়ন হয়নি। বিরোধী দল দমন ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সরকার যতটা মরিয়া ছিল, ততটাই উদাসীন ছিল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে। বড় বড় প্রকল্পের নামে জনসাধারণকে স্বপ্নে বিভোর রাখার যতটা চেষ্টা দেখা গেছে, বাস্তবায়নের উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি তার ছিটেফোঁটাও। অনুন্নয়ন খাতের ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে প্রতি বছরই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-তে কাটছাঁট করা হয়েছে বড় ধরনের। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ, ঢাকায় পাতাল রেল, মনোরেল, সার্কুলার রেলপথ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, গণপরিবহন সমস্যার সমাধান, যানজটমুক্ত ঢাকা উপহার দেয়া, ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার (অরবিটাল) জলপথ তৈরি, টানেল নির্মাণ, চার লেনবিশিষ্ট ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক তৈরি, রেলপথ সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন। কিন্তু এসবের একটি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নও দেখেননি দেশের মানুষ। আগামী দুই বছরেও এগুলো বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
বাস্তবায়িত হয়নি ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ মহাজোটের এমপি প্রার্থীদের দেয়া উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিগুলোও। এসব নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের এমপিরাও এলাকায় চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। এলাকায় গেলে তারা মানুষের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এমপিদের অনেকে মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিচ্ছেন নিজ এলাকার উন্নয়নে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য, কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছেন না।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল—পদ্মা সেতু নির্মাণ, পরিবহন, সড়ক নির্মাণ, গৃহায়ন, বন্দর উন্নয়ন ও নির্মাণে উপযুক্ত নীতিমালা গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক নেটওয়ার্কে গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা সদরকে সংযুক্ত করার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। এসব প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। সারাদেশের কোথাও এক কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মিত হয়নি গত ৩ বছরে। দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু থেকে অর্থ সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবিসহ দাতা সংস্থাগুলো। এখন পদ্মা সেতু তৈরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। রেলপথ বাড়েনি এক ইঞ্চিও। রেলওয়ের উন্নয়নে ১২টি প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তার একটিও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে দেশের চাইতে প্রতিবেশী ভারতের স্বার্থ দেখা হয়েছে বেশি। তাদের ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘এশীয় রেল ও জনপথের আওতায় পাশের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা হবে।’ এই ইশতেহার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার নেপালের সঙ্গে রেল ট্রানজিট (পণ্য পরিবহন) ফের চালু করেছে। তবে রেললাইনের উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি। এখন বলা হচ্ছে, ভারতকে করিডোর দেয়ার জন্য ত্রিপুরার আগরতলা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন যোগাযোগ স্থাপন করা হবে।
সারাদেশে ছোট-বড় ৩১০টি নদী। ফারাক্কাসহ ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ৪২টিতে বাঁধ দেয়ায় দেশের নদীগুলোতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে; কমে গেছে নৌপথ। আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি ছিল ‘প্রতিটি ছোট-বড় নদী খনন করা হবে এবং তা যেন সারাবছর নাব্য থাকে তার ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিরাপদে স্বল্প খরচে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য নৌপথের উন্নয়ন ও নৌ পরিবহনের আধুনিকায়ন করা হবে।’ মহাজোটের গত তিন বছরে নদী খননের বড় বড় কয়েকটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে, কিন্তু এর একটিরও বাস্তবায়ন হয়নি।
বাস্তবায়ন হয়নি বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে আধুনিকায়ন করার প্রতিশ্রুতিও। স্থলবন্দরগুলোও আধুনিকায়ন হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি ভারত সফরকালে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করা ৫০ দফা ইশতেহারের ২৩ নম্বর দফায় বাংলাদেশে সড়ক ও রেলপথে ভারত থেকে পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ইশতিহারে ছিল ‘বাংলাদেশ বিমানকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার। আওয়ামী লীগ সরকারের ৩ বছরে মন্ত্রীর বদল হলেও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হয়নি বিমান। বাংলাদেশ বিমানে একটি নতুন বিমান সংযোজন ছাড়া গত ৩ বছরে বিমানের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।
জেলাপর্যায়ে এমপিদের যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল সেগুলোও বাস্তবায়তি হয়নি আওয়ামী লীগ শাসনের এই ৩ বছরে। পঞ্চগড় জেলায় স্কুল-কলেজ নির্মাণসহ সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল বাংলাবান্দা স্থলবন্দর চালুর। কিন্তু এই বন্দর চালু করা সম্ভব হয়নি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ সড়ক, জেলা ও উপজেলা পরিষদের রাস্তাসহ সব রাস্তাঘাটেরই বেহাল দশা—খানাখন্দে ভরা। গ্রামীণ জনপদের সড়কগুলো মেরামত না হওয়ায় মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা সড়কটির বেহাল দশার কথা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কালিয়াপাড়া থেকে কচুয়া পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক বেশ ক’বছর ধরেই নাজুক। গত ৩ বছরে স্থানীয় এমপি ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের কাছে বার বার ধরনা দিয়েও সড়কটি মেরামত করানো যায়নি। পুরো উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়ার সড়কগুলোরও বেহাল দশা। আশরাফ গ্রামের আবু তালেব মেম্বার জানান, তার বাড়ি থেকে উপজেলা সদর ১৪ কিলোমিটার। এই ১৪ কিলোমিটার রাস্তা বাসে গেলেও শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়।
দিনাজপুরে গত ৩ বছরে জেলা স্কুলের সামনে একটি পাবলিক টয়লেট ছাড়া পুরো জেলায় দৃশ্যমান আর কোনো উন্নয়ন হয়নি। ঠাকুরগাঁওয়ে পানিসম্পদমন্ত্রী থাকার সুবাদে সদর উপজেলার পার্শিদেবীতে রেগুলেটর কাম ব্রিজ নির্মাণাধীন রাবার ড্যাম ও শ্রীপুর কলেজে এক একাডেমিক ভবন ছাড়া তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। সৈয়দপুরে ২০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ ও বিমানবন্দরকে আধুনিয়াকয়নের প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু সেগুলো আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এভাবে দেশের প্রত্যেকটি আসনে আওয়ামী লীগ মহাজোটের এমপিদের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এসব নিয়ে মহাজোটের শরিক এবং আওয়ামী লীগের এমপি—সবাই ক্ষুব্ধ।
গত রোববার মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এই সরকারের দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু হয়নি। পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দুর্নীতির কারণে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ঘরে ঘরে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। লাখ লাখ টাকা ঘুষ ছাড়া এখন চাকরি হয় না কোথাও। দেশের কোথাও অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন দেখা যায় না।
সম্প্রতি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের এমপি বলেন, অতীতে কী হয়েছে সেটা এখন দেখার বিষয় নয়। আমার সামনে সবচেয়ে বড় কাজ হলো পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করা। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, আমার প্রথম অগ্রাধিকার হবে মানুষের দুর্ভোগ কমিয়ে স্বস্তি নিশ্চিত করা।
এই সরকারের প্রতি এখনও জনগণের বিপুল প্রত্যাশা আছে। হাতে সময় কম হলেও তহবিলের দিকে নজর রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানো হবে। এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক, সময় কম। পথ অনেক, জ্বালানি কম। এর মধ্যেই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।