Monday 31 October 2011

শ্রমজীবী মানুষ দিশেহারা : দ্রব্যমূল্য বাসাভাড়া চিকিত্সা ও পরিবহনব্যয় নাগালের বাইরে



আলাউদ্দিন আরিফ
রিকশা-ভ্যানচালক আবুল হাশেমের মাসিক আয় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। তিন বছর আগে এর অর্ধেক টাকা রোজগার করেও আটজনের সংসার তিনি একাই চালিয়েছেন। এখন ভ্যানের ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু এ আয়েও এখন তিনি আর সংসার চালাতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে তার স্ত্রী খিলগাঁও তিলপাপাড়ায় দুটি বাসায় বুয়ার কাজ করেন। এ মাসে মেজো মেয়েটিকে কাজ দিয়েছেন সুতার ফ্যাক্টরিতে। এখনও বেতন ধরেনি কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে স্বামী-স্ত্রীর আয় প্রায় ১১ হাজার টাকা। আয় আগের তুলনায় বাড়লেও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়নি একচুলও। বরং কমেছে। বেড়েছে সংসারে অভাব-অনটন আর অশান্তি। পরিবার-পরিজন নিয়ে খিলগাঁও তিলপাপাড়া বক্সকালভার্ট সড়কের পাশে টিনের ঘরটিতে থাকছেন ৬ বছরের বেশি সময় ধরে। উঠে ছিলেন ৭০০ টাকা ভাড়ায়। এখন সেই বাড়ির ভাড়াই দিচ্ছেন সাড়ে তিন হাজার টাকা। কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার আড্ডা গ্রামের বাসিন্দা আবুল হাশেম বলেন, ‘চাইর বছর আগেও দিনে ত্রিশ টিয়া (টাকা) দামের হোয়ার (সোয়া কেজি) চাইল, আর ত্রিশ-চল্লিশ টাকার তরিতরকারি (শাকসবব্জি) কিনলে ভালামতন খাওন যাইত। কিন্তু অনে দিনে তিনশ’ টেয়ায়ও সারে না। হোয়ার চাইলে যায় ষাইট টিয়া, একশ’ টিয়ার তরতরকারি কিনলে একদিন চলে না।’ বয়স পঞ্চাশে পড়া হাশেম বলেন, স্যার আমরা বাইচমু কেমনে।’
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আবুল হাশেমের মতোই অবস্থা নগরীর নিম্নআয়ের মানুষের। সবারই একটা প্রশ্ন—আমরা বাঁচব কী করে? গতকাল খিলগাঁও রেলক্রসিংয়ের নিচে নিজের ভ্যানের ওপর বসে জিরিয়ে নেয়ার সময় হাশেম বলেন, বড় মেয়েটাকে গত বছর বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের সময় গ্রামের বাড়িতে কিছু জমি বন্ধক দিয়ে ও ঢাকায় এসে ভ্যান চালিয়ে সঞ্চিত চল্লিশ হাজার টাকা যৌতুক দিয়েছেন মেয়ের জামাইকে। কিন্তু এখন মেয়ের স্বামী একটা ক্যামেরা মোবাইল সেট চায়। মোবাইল না দেয়ায় মেয়েকে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে, মোবাইল না নিয়ে যাতে স্বামীর ঘরে না যায়। আবুল হাশেম কী করে টাকা জমিয়ে একটা মোবাইল কেনা যায় সেই চিন্তায় অস্থির।
ঢাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য আর বাসা ভাড়া। এ দুটির লাগাম টেনে ধরতে পারছে না কেউ। সেই সঙ্গে বেড়েছে বাস ভাড়া, রিকশা ভাড়া, শিক্ষা ও চিকিত্সা ব্যয়। ফলে সীমিত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ আছেন চরম বিপাকে। বাড়তি খরচের ধাক্কা আসছে বাড়িওয়ালা, সবজিওয়ালা, দোকানদার, রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকেও। বাসায় গেলে বাড়িওয়ালার দাপট, বাজারে বিক্রেতার দৌরাত্ম্য, রাস্তায় রিকশা গাড়ির দৌরাত্ম্য। সবদিক থেকেই বেসামাল নগরজীবন। তেল-গ্যাসের ভর্তুকি কমানোর অজুহাতে দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মানুষের জীবনে বিরাজমান অভাবকে আরও তীব্র করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না মানুষ। এতে অভাব-অনটন বাড়ার পাশাপাশি যৌতুকের দাবিতে বাড়ছে নারী নির্যাতন। দেখা দিচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা।
নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবজি, মাছ, মাংস, চাল ও তেলসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের সংসারের চাকা এখন চলছে না। অর্থনীতির হিসাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ঠেকেছে ১২ শতাংশের বেশি। সীমিত আয়ের মানুষের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বড় ধাক্কা লেগেছে দিনমুজুর থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তের জীবনেও। বাজারে ভালো মানের চাল কেজিপ্রতি ৪৫ থেকে ৬০ টাকা। মোটা চাল মিলছে না ৩৬ টাকার কমে। ওএমএসের চালের দামও ২৪ টাকা কেজি। চাল নিয়ে ওএমএসের ট্রাক এখন আর যায় না স্পটগুলোতে। সাধারণ মানুষ বলছেন, গত রমজানের আগ পর্যন্ত শাকসবজির দাম ক্রেতার নাগালের মধ্যে ছিল। তখন সবজি দিয়ে অন্তত দু’বেলা ভাত খেতে পেরেছে মানুষ। কিন্তু সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর ওই সুযোগও আর নেই। এখন সবজির দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, ক্রেতারা সবজির দোকানে যেতেও ভয় পান। পেঁপে আর আলু ছাড়া বাজারে ৫০ টাকার কমে কোনো সবজি নেই। তাহলে মানুষ খাবে কী?
খিলগাঁও শাহজাহানপুরে একটি ফার্নিচার দোকানের পলিশ মিস্ত্রি চাঁনমিয়া। রোজ মজুির নেন ৪০০ টাকা। দু-আড়াই বছর আগে মজুরি নিতেন ২০০ টাকা। মাত্র দু’বছরে বলা যায় তার আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। বাজারে জিনিসপত্রের দাম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রথমেই চাঁনমিয়া বলেন চাল, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, ডাল ইত্যাদির কথা। মোটা চালের দাম ১৮ থেকে ৪০ টাকা। পেঁয়াজ ১৬ থেকে ৪০-৪২ টাকা, কাঁচামরিচের দাম ৪০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। আগে বাড়িভাড়া দিতেন ১২শ’ টাকা। এখন দেন ৩২শ’ টাকা। চাঁনমিয়া বলেন, তাদের কাজ রোজ হিসেবে। কোনোদিন কাজ থাকে কোনোদিন থাকে না। তারপরও সপ্তাহে একদিন মার্কেট থাকে বন্ধ। এছাড়াও হরতালসহ বিভিন্ন কারণে মাসে আরও এক-দু’দিন মার্কেট বন্ধ থাকে। সব মিলিয়ে মাসে গড়ে ১৫ থেকে ১৮ দিন কাজ করেন। মাসের বাড়িভাড়া, বিদ্যুত্ বিল, খাবার খরচসহ অন্যান্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে অসম্ভব আর্থিক টানাটানিতে পড়ছেন। প্রতি মাসেই ঋণ করতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ডাচবাংলা ব্যাংকের টিএসসি বুথের গার্ড মোয়াজ্জেম জানালেন, দৈনিক ডিউটি ৮ ঘণ্টা। বেতন ৩ হাজার ৬০০ টাকা। এ সামান্য বেতনে চলেন কী করে উত্তরে বলেন, রোজ একটি ওভারটাইম পান তারা। অর্থাত্ ৮ ঘণ্টার স্থলে ডিউটি করতে হয় ১৬ ঘণ্টা। এতে মাসে তার সাকুল্যে আয় হয় ৭ হাজার টাকা। মোয়াজ্জেম জানালেন, কিছুদিন আগেও বেতনের টাকায় থাকা-খাওয়া সেরে ওভারটাইমের টাকাগুলো বাড়িতে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু এখন সেটা পারছেন না। ওভারটাইমেরও অর্ধেক টাকা খরচ হয়ে যায় থাকা-খাওয়া আর পকেট খরচ বাবদ। বাড়িতে মাসে হাজার দুয়েক টাকা পাঠানো মুশকিল হয়ে পড়ে তার।
খিলগাঁওয়ের গৃহবধূ তাহমিনা বেগম বলেন, তার স্বামী দু’বছর আগে যে বেতন পেতেন এখনও তাই পাচ্ছেন। নানা জটিলতায় অফিসে তার স্বামীর বেতন বাড়ছে না। স্বামীর বেতন প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আগে মোটামুটিভাবে মাসের খরচ শেষে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারতেন। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হয় না। প্রতি মাসেই অভাবে পড়তে হয়। উদাহরণ দিয়ে বলেন, এই দু’বছরে বাসাভাড়া বেড়েছে ২ হাজার টাকা। বিদ্যুত্ ও ডিশলাইনের বিল বেড়েছে প্রায় চারশ’ টাকা। এর বাইরে তাদের একমাত্র মেয়েকে আগে ডাক্তার দেখিয়ে যেখানে ডাক্তারি ফি দিতেন ৩০০ টাকা, এখন তা দিতে হয় ৬০০ টাকা। গত কয়েক বছরে শিশুর দুধসহ অন্যান্য শিশুখাদ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘এক কেজি ডিপ্লোমা গুঁড়ো দুধ দুই বছর আগে কিনতাম ৩৬০ টাকায় এখন কিনতে হচ্ছে ৫৭০ টাকায়। ৩০ টাকা কেজির চিনি হয়েছে ৭০ টাকা। ৫ টাকা দামের একটি চকোলেটের দাম হয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। আগে মিনিকেট চাল কিনতেন, এখন কিনছেন স্বর্ণা। মাছ-মাংস কেনা কমিয়েছেন। কিন্তু একমাত্র মেয়ে কিছু চাইলে তো আর না দিয়ে পারা যায় না। দাম যতই বাড়ুক নিজে না খেয়ে হলেও অন্তত বাসা ভাড়া আর সন্তানের খাবারের টাকা তো জোগাড় করতে হয়। তার ওপর গ্রামের বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়িকে টাকা পাঠাতে হয়, তাদের চিকিত্সা ও ওষুধ কিনে দিতে হয়। এসব করতে গিয়ে প্রতি মাসেই ঋণ করতে হচ্ছে। সঞ্চয় আগেই শেষ। মাসের ঋণ মাসে পরিশোধ করতে না পারায় এখন আত্মীয়স্বজনের কাছে ঋণ চাইলেও পাওয়া যায় না। বিভিন্ন অজুহাতে নিষেধ করে দেন। তাহমিনা বলেন, রিকশাচালক রিকশাভাড়া বাড়াতে পারে, বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারে কিন্তু আমাদের মতো চাকরিনির্ভর মানুষ ইচ্ছে করলেই বেতন বাড়িয়ে নিতে পারেন না। ফলে এ ঊর্ধ্বগতির বাজারে নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ দূরে থাক—বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে পড়েছে।
গতকাল মালিবাগ বাজারের পাশে ওএমএসের চাল কেনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সুরাইয়া, হাফসা ও মরিয়মসহ কয়েকজন। বেলা তখন সাড়ে ১২টা। তাদের একজন সুরাই খা সে অসুস্থতার কথা বলে গার্মেন্ট থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। ওই সময়েও ওএমএসের ট্রাক আসেনি। এলে সবার আগে লাইনে দাঁড়াবেন এজন্য অপেক্ষা। তারা জানান, প্রায়ই ট্রাক আসে না। অপেক্ষমাণ এসব মানুষ বলেন, তিন বছর আগেও মোটা চাল কিনতেন সতের আঠার টাকা কেজিতে। আর এখন সরকারি ওএমএসের মোটা চালও কিনতে হয় ২৪ টাকা কেজিতে। বাজার থেকে কিনতে হয় ৩৮ টাকায় অর্থাত্ চালের দাম বেড়েছে আড়াইগুণ। সুরাইয়া বলেন, তিন বছর আগে তিনি গার্মেন্টে সুইং অপারেটর হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন মাত্র এক হাজার টাকা বেতনে। এখন সেই বেতন হয়েছে সাড়ে চার হাজার টাকা। কিন্তু সুরাইয়ার ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি এই বাড়তি বেতনে। কারণ তার মেসের খরচ, চাল ডালের খরচ দিয়ে বাড়িতে এক হাজার টাকা পাঠানো খুবই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
কারওয়ান বাজারে একটি বেসরকারি অফিসে অফিস সহকারী শামসুদ্দীন মিয়া। বাসা ঢাকার মানিকনগর এলাকায়। ৫ ছেলে তার। নিজে বেতন পান ৫ হাজার টাকা মাসে। তিন ছেলে কর্মজীবী। এক ছেলে অন্য একটি অফিসে অফিস সহকারী। দুই ছেলে দোকান চালায়। আর ছোট দুই ছেলে পড়ছে। বাবা ও ৩ ছেলের আয় মাসে প্রায় ১৬ হাজার টাকা। মেস বাসাভাড়া দেড় হাজার, প্রত্যেকের খাওয়া খরচ মাসে প্রায় ২ হাজার। এসব খরচ মিটিয়ে মাসে হাজার তিনেক টাকা বাড়িতে পাঠানো দুষ্কর হয়ে পড়ে শামসুদ্দীন মিয়ার।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করে কয়েক বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আনোয়ার উল্লাহ। তিনি অবসর নেয়ার সময় সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন মোট ১৬ লাখ টাকা। পুরো টাকা দিয়েই তিনি জাতীয় সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন। যা থেকে তিন বছর আগেও ১৪ শতাংশ হারে সুদসহ মাসে ২০ হাজার টাকা পেতেন। বর্তমানে সরকার এই সুদের হার কমিয়ে ১২ শতাংশ করেছে। তার ওপর সুদের ওপর ট্যাক্স বসিয়েছে। ফলে আনোয়ার উল্লাহর সংসারের আয় কমে গেছে। পেনশনের চার লাখ টাকা ছেলেকে দিয়েছেন শেয়ারবাজারে খাটানোর জন্য। কিন্তু তার ছেলে এরই মধ্যে দুই লাখ টাকা লোকসান করেছে। একদিকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমে গেছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজারে ছেলের লোকসান। সব মিলিয়ে আনোয়ার উল্লাহর সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা। তিনি বলেন, শুধু চাল, ডাল, মাছ ও তরকারি দাম বেড়েছে তাই নয়; সাবান, কসমেটিকসসহ এমন কোনো জিনিস নেই যার দাম বাড়েনি। শুধু দাম বাড়েনি আমার ছেলের শেয়ারগুলোর।
রংপুরের রিকশাচালক মোজাম্মেল হক। ঢাকায় এসেছেন প্রায় ৬ বছর। বললেন এখন মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা কামাই করেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি বলেন, মাত্র ৫ বছর আগেও খিলগাঁও রেলগেট থেকে মৌচাক যেতেন ৮ টাকা বা ১০ টাকায়। এখন নেন ২৫ টাকা। আগে মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করে ঢাকায় মেসের ভাড়া, খাওয়া খরচ, চা সিগারেটের খরচ মিটিয়ে আড়াই হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু এখন ১০ হাজার টাকা কামাই করেও আড়াই-তিন হাজার টাকা পাঠানো সম্ভব হয় না। প্রতিদিনকার খরচের বিবরণ তুলে ধরে মোজাম্মেল জানান, মান্ডার একটি গ্যারেজের রিকশা তিনি চালান। রিকশার জমা রোজ ১০০ টাকা। রোজ হিসেবেই মেসে থাকেন। রাতের খাওয়াসহ মেস ভাড়া রোজ ৮০ টাকা। রাস্তায় রিকশা নিয়ে বেরুলে দুপুরের খাবার ও সকালের নাস্তা, চা সিগারেটসহ খরচ আরও ১০০ টাকা। সব মিলিয়ে ৩০০ টাকা তার দৈনিক খরচ। ফলে এখন মাসে হাজার তিনেক টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেন। ওই টাকা দিয়ে বাড়িতে তিন সন্তান, মা ও স্ত্রীর খাওয়াসহ যাবতীয় ব্যয় বহনে হিমশিম খাচ্ছেন। মোজাম্মেল বলেন, স্যার হুনছি চাইলের কেজি ১০০ ট্যাকা হবি, তাইলে মোরা বাঁচমো কেমনে।
খিলগাঁও বাজারে মিনতির কাজ করে সাইফুল, কামাল, তিনি রাশেদসহ বেশ কয়েকজন। বাজারে ঢুকলেই বড় ঝুড়ি মাথায় নিয়ে পিছে পিছে ঘুরে বলে স্যার ‘মিনতি নিবেননি, মিনতি লাগবোনি’। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারেই মিনতিদের দেখা মেলে। শাক-সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় এই মিনতিরা পড়েছেন মহাবিপাকে। মানুষ সবজি কেনা কমিয়ে দেয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়ছেন তারা। খিলগাঁও বাজারের মিনতি সাইফুল বলেন, আগে দিনে এক হাজার টাকা পর্যন্ত কামাই করেছেন। কিন্তু এখন সারা দিনে ২০০ টাকাও আয় করা যাচ্ছে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে অমানবিক জীবনযাপন করতে হচ্ছে।’ আরেক মিনতি রাশে বলেন, শাক-সবজি ও মাছের দাম বাড়ায় মানুষ যে কেনাকাটা করে তাদের ব্যাগই ভরে না। লোকজন হাতে করেই ব্যাগ নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছে। মিনতি প্রয়োজন হয় না। কেবল মহল্লার কিছু সবজি ব্যবসায়ী ও হোটেল মালিকরা মিনতি নেন। কিন্তু তারা আবার পারিশ্রমিক দেয় খুবই কম। এতে সামান্য কিছু রোজগার হয়। যার ফলে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে না। কারওয়ান বাজারের মিনতিদের ঝুড়ির মালিক বললেন, দিনে ১০ টাকা ভাড়ায় ঝুড়ি নেয় মিনতিরা। এক ঝুড়ি ভাড়া দেয়া রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০০ ঝুড়ির মধ্যে এখন তিনি ভাড়া দিতে পারেন মাত্র ৮০টি। বাকিগুলো পড়েই থাকে।
নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান বলেন, জিনিসপত্রের দাম যে বাড়ছে তা মানুষের কাছে বোঝাস্বরূপ। শুধু সীমিত আয়ের মানুষই নয় সব শ্রেণীপেশার মানুষ এখন কষ্টে দিন পার করছে। সরকার নির্বাচনের আগে জিনিসপত্রের দাম কম রাখার যে অঙ্গীকার করেছিল এখন তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ভোগ্যপণ্যের দাম কমানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, দ্রব্যমূল্য বাড়লে সীমিত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা খুবই করুণ হবে এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান সরকারের পক্ষে তো নয়ই পরে বিএনপি বা অন্য কোনো সরকারের পক্ষেও এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজসাধ্য হবে না। সামষ্টিক অর্থনীতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। বৈদেশিক সাহায্য কমে গেছে। সরকার ঋণ নিয়ে দেশ চালাচ্ছে। সরকারের ঋণ দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা ছাপিয়ে সরকারের চাহিদা পূরণ করছে। এতে প্রতিনিয়ত মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সরকার বেশিদামে জ্বালানি এনে কম দামে বিক্রি করছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো থেকে বেশি দামে বিদ্যুত্ কিনে কম দামে বিক্রি করছে। যাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে। কৃষি ও খাদ্যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সরকারের আয় কম ব্যয় অনেক বেশি। নতুন টাকার সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি হবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আর সীমিত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কাগুজে মুদ্রা ছেপে সাময়িকভাবে সঙ্কট সামাল দেয়া হলেও মূল্যস্ফীতির ওপর এর প্রভাব ভয়াবহ। কেনা ব্যবসায়ীরা যদি মনে করেন, এরকম মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে তাহলে তারা পণ্যমূল্যের সঙ্গে তাদের দৃষ্টিতে সম্ভাব্য মূল্যস্ফীতির হারটি ধরে নিয়ে দাম হাঁকবেন। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেসামাল হয়ে পড়বে। সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়বে। বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভয়াবহ ভঙ্গুর মধ্যে পড়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তার কাজের সমালোচনা হলে বা সরকারের কোনো পদক্ষেপের সমালোচনা করলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে রূঢ় স্বরে বলেন, রাবিশ। এখন প্রশ্ন তার ওপর ন্যস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে তিনি কী বলবেন?
বাংলাদেশ কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন ক্যাব সভাপতি কাজী ফারুক বলেন, ‘বাসাভাড়া, গাড়িভাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মানুষ দৈনন্দিনের ব্যয় কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু এখন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তারা আর ব্যয় কমানোর কোনো খাত খুঁজে পাচ্ছে না। ধারদেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে। এ অবস্থা বেশিদিন চললে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। সরকারের উচিত সবার আগে দ্রব্যমূল্য ও জীবন যাত্রার ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়া।

উন্নয়ন কাজের নামে লুটপাট









কাদের গনি চৌধুরী
উন্নয়ন কাজের নামে চলছে ব্যাপক লুটপাট। টেন্ডারের ৬০ ভাগ টাকা চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেট ও ঠিকাদারদের পকেটে। বাকি ৪০ ভাগ টাকার কাজ হচ্ছে দেশে। ফলে কাজের কোনো মানই বজায় থাকছে না। সবচেয়ে বেশি অর্থ লোপাট হচ্ছে সড়ক, ব্রিজ নির্মাণ ও সংস্কার, নদী খনন, বাঁধ নির্মাণ এবং বিভিন্ন মেরামত কাজে। কাজ না করেও নদী খনন, বাঁধ নির্মাণের নামে পুরো টাকা তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা রাজস্ব কোষাগারে জমা বা দাতাগোষ্ঠীকে ফেরত না দিয়ে আত্মসাত্ করা হচ্ছে। এ ধরনের বেশ কিছু অনিয়ম তদন্ত করছে দুদক।
সড়ক ও এলজিইডিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি কাজের সব টেন্ডারই বাগিয়ে নিচ্ছে সরকারি দল। তাই প্রকৃত ঠিকাদাররা কোনো কাজই পাচ্ছেন না। অধিকাংশ ঠিকাদার বেকার হয়ে পড়েছেন। এদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে ১০% কমিশনে কাজ কিনে নিয়ে কোনোমতে পেশায় টিকে আছেন।
এলজিইডির ঠিকাদাররা জানান, কাজের অর্ধেক টাকা তাদের ব্যয় করতে হয় মন্ত্রণালয়, সরকারি দল, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারের পেছনে। ফলে কাজের মান তারা বজায় রাখতে পারছেন না। এর ফলে যে রাস্তা পাঁচ বছর পর সংস্কার করার কথা সেটি এক বছরেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। একাধিক ঠিকাদার ও এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলজিইডির বিভিন্ন পর্যায়ে কাজের সাড়ে ১৩ পার্সেন্ট, সরকারি দল থেকে কাজ কিনে নিতে দশ পার্সেন্ট, প্রকল্প পরিচালক, কনসালটেম্লট, ল্যাবরেটরি, লোকাল চাঁদাবাজদের ম্যানেজ করতে ১০ পার্সেন্ট, ঠিকাদারের লাভ ১৫ পার্সেন্ট এবং মন্ত্রণালয়কে ১০ পার্সেন্ট ঘুষ দিতে হয়। ঠিকাদাররা জানান, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীকে তিন পার্সেন্ট, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী দুই পার্সেন্ট, উপজেলা প্রকৌশলীকে সাড়ে তিন পার্সেন্ট, সহকারী প্রকৌশলী (সিনিয়র) এক পার্সেন্ট, জুনিয়র এক পার্সেন্ট, উপ-সহকারী প্রকৌশলী হাফ পার্সেন্ট, কাজের কনসালটেম্লট গ্রুপ এক পার্সেন্ট, হিসাব বিভাগ এক পার্সেন্ট, ট্রেজারি বিভাগ হাফ পার্সেন্ট এবং গুণগত মান সার্টিফিকেটের জন্য ল্যাবরেটরিকে দিতে হয় আরও হাফ পার্সেন্ট। এলজিইডির সাড়ে ১৩ পার্সেন্ট ভাগবাটোয়ার ঘটনা ওপেন সিক্রেট। এটা নিয়ে দরকষাকষির প্রয়োজন পড়ে না। আপনা আপনিই নিজ নিজ ডেস্কে এ টাকা চলে যায়।
সড়ক বিভাগের কাজে মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করতে ১০ থেকে ২০ পার্সেন্ট পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। অন্যান্য জায়গায় দিতে হয় আরও ২০ থেকে ২৫ পার্সেন্ট ঘুষ। এটাও ওপেন সিক্রেট। এর জন্যও দরকষাকষির প্রয়োজন পড়ে না। কোথায় কত টাকা দিতে হবে টেন্ডার পাওয়ার আগেই বলে দেয়া থাকে। সরকারি দলের ঠিকাদার থেকে কাজ কিনে নেয়া এবং ঠিকাদারের লভ্যাংশ বাদ দিলে ৪০ পার্সেন্টের বেশি টাকার কাজ হয় না বলে সড়ক ও যোগাযোগ বিভাগের একটি সূত্র জানায়।
ওয়াসার কাজে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় বলে জানান ঠিকাদাররা। ওয়াসার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিতে হয় কাজের ২০ পার্সেন্ট। এদের মধ্যে ভাগ পান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর দফতর। এমডির জন্য ভাগ থাকলেও বর্তমান এমডি ঘুষ খান না
বলে একাধিক ঠিকাদার জানান। এছাড়া কাজ ক্রয়, ঠিকাদারের লাভ এবং অন্যান্য খাতে চলে যায় ৪০ পার্সেন্ট টাকা। বিশেষ করে অগ্রিম আয়কর হিসেবে সাড়ে আট পার্সেন্ট টাকা শুরুতেই কেটে রাখা হয়। নিরাপত্তা জামানত হিসেবে এক বছরের জন্য জমা রাখা হয় আরও ১০ পার্সেন্ট। ওয়াসার একটি সূত্র জানায়, গত আড়াই বছর ধরে যত টেন্ডার হয়েছে এর সবই পেয়েছেন সরকারি দলের নেতা ও সরকার সমর্থক ঠিকাদাররা। ফলে পেশাদার ঠিকাদারদের থাকতে হয়েছে বেকার । অনেকে সরকারি দলের নেতাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে কাজ করছেন।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, পিডব্লিউডি, রাজউক, সিটি করপোরেশন, বিআইডব্লিউটিএ, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সব জায়গায় একই অবস্থা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদার জানান, তিনি এলজিইডির প্রায় এক কোটি টাকার একটি কাজ কিনে নেন ১৫ লাখ টাকায়। এছাড়াও তাকে এলজিইডিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আরও ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তিনি জানান, এখনও কনসালটেম্লট গ্রুপ, হিসাব বিভাগ, ট্রেজারি বিভাগ এবং গুণগত মান সার্টিফিকেটের জন্য ল্যাবরেটরিকে তাদের পার্সেন্টেস দেয়া হয়নি। ক্ষোভের সঙ্গে ওই ঠিকাদার জানান, এখন যদি ৭০ ভাগ কাজ করি তাহলে বাবার জমি বিক্রি করে এনে সরকারি কাজ করতে হবে। সড়কের এক প্রকৌশলী জানান, মন্ত্রণালয় ও সওজ কর্মকর্তাদের দাবি মতো টাকা দিতে না পারায় তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ এনে ওয়ার্ক অর্ডার বাতিলের চেষ্টা করলে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন।
প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা আত্মসাত্ : সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডির অধিকাংশ প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা রাজস্বখাতে জমা না দিয়ে আত্মসাত্ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এলজিইডির আরডিপি-২১ প্রকল্প ক্লোজিংয়ের সময় প্রায় ১০ কোটি টাকা অব্যয়িত থেকে যায়। এ টাকা রাজস্বখাতে জমা না দিয়ে তত্কালীন পিডি প্রকল্পের অননুমোদিত পূবালী ব্যাংক, ফার্মগেট, ঢাকা’র এসটিডি-৩৪ নম্বর হিসাবের মাধ্যমে আত্মসাত্ করা হয়। বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত ও পল্লী উন্নয়ন পুনর্বাসন প্রকল্প ২০০৪-এও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ প্রকল্পের অব্যয়িত প্রায় ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে সরিয়ে ফেলা হয়। এ ব্যাপারে দুদকে মামলা হলে দ্রুত তা জমা দিয়ে দেয়া হয়। একইভাবে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প আরডিপি-১৩, ১৮ ও ২৫ প্রকল্পের অব্যয়িত টাকাও আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, সিএইচটি আইডিপি প্রকল্পের আওতায় রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়কের আসাম বস্তিসংলগ্ন ৯৬ মিটার দীর্ঘ ব্রিজের অ্যাপ্রোচ রোড না করে প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ ব্যয় করার লক্ষ্যে শুকনো স্থানে আরও একটি ২০৪ মিটার দীর্ঘ ব্রিজ তৈরি করে প্রায় ২ কোটি টাকা সিএইচটি আইডিপি প্রকল্পের পরিচালকের সহায়তায় লুটপাট করা হয়।
কাজ না করে ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বিল প্রদানের ঘটনাও ঘটেছে এখানে। এলজিইডির একটি সূত্র জানায়, বরগুনা জেলার পাথরঘাটা, কাকচিরা, বামনা, রাজাপুর, কাটালিয়া সড়কটি সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন হলেও ২০০৭ সালে এটি সংস্কার করে এলজিইডি। নামসর্বস্ব পত্রিকায় গোপনে বিজ্ঞাপন দিয়ে টেন্ডারের মাধ্যমে বরাদ্দ ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকার সমুদয় বিল প্রদান করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। ঠিকাদার ঘুষ দিয়ে সামান্য কাজ করে পুরো টাকা উঠিয়ে নেয়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সূত্রে জানা যায়, এলজিইডিতে বছরে প্রায় ৬২৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। এলজিইডির অভ্যন্তরীণ তদন্তে দুর্নীতির গড় অনুমিত হিসাব ১০৩ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে বিগত দু’বছরে প্রধান প্রকৌশলীর দফতরে জমা পড়া অভিযোগ, অভিযোগের তদন্ত এবং দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হওয়া টাকার অঙ্কের গড় হিসাবে দুর্নীতির এ চিত্র পাওয়া গেছে। গত তিন বছরে ১২৭ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে এলজিইডিতে। এর মধ্যে ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
এলজিইডির একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই শত ভাগ কাজ দেখিয়ে বিল তুলে নেয়া, সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত স্থাপনা নির্মাণ, কর্মকর্তাদের স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে অবৈধভাবে ওইসব প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ বরাদ্দ দেয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণের টাকা অপচয় করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, এলজিইডিতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় গ্রামাঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ ও সড়ক সংস্কার প্রকল্পে। বছরে সড়ক সংস্কারের জন্য সহস্রাধিক ছোট ছোট প্রকল্প হাতে নেয়ার মতো দুর্নীতি হচ্ছে এখানে। এসব প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রথমেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘুষের কারণে এসব প্রকল্পের ব্যয় শুরু থেকেই বেশি ধরা হয়। কোনো সড়ক উন্নয়নে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হলেও তা দেখানো হয় ৭ কোটি টাকা। প্রকল্প অনুমোদনের পর টেন্ডার প্রক্রিয়ার জালিয়াতি ওপেন সিক্রেট। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি, মন্ত্রী ও সচিব প্রভাববিস্তার করেন বলে অভিযোগ আছে। সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী সুযোগ বুঝে আগেই সমঝোতা করে নেন স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে। আর এ সমঝোতার ফল হিসাবে বেশিরভাগ প্রকল্প শত ভাগ বাস্তবায়ন না করেই বিল তুলে নেয়া হয়। বছরের পর বছর একই সড়ক নতুন প্রকল্প হিসাবে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে টেন্ডার জালিয়াতি এবং ভুয়া বিলের অভিযোগই বেশি পাওয়া যায়।
এলজিইডিতে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এখানে তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ না করলে কাজ পাওয়া যায় না বলে সূত্র জানায়। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেছে বলে জানা গেছে। দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ হিসাবে এই প্রধান প্রকৌশলীর সম্পত্তির হিসাব চেয়ে নোটিশ দেয়া হয়। দুদক তদন্ত করে জানতে পারে, প্রধান প্রকৌশলী তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুনের নামে দেড় বিঘা জমির ওপর বাড়ি নির্মাণ করেছেন। ৬ ইউনিটের এই বাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য ১৫ কোটি টাকা। তাছাড়া গাজীপুরে বাগানবাড়ি, কুমিল্লায় দেড়শ’ বিঘা জমি, কাঁচপুরে জমি এবং ৫টি ব্যাংকে স্ত্রী সুফিয়া খাতুন ও মেয়ে বদরুন্নাহার দীনার নামে ১৯ লাখ টাকার এফডিআর রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিভাগের এলজিইডির সহকারী প্রকৌশলী মো. আতিয়ার রহমান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও ঢাকা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী খুরশীদ আলমকে নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যারা এলজিইডিকে লুটপাট করে খাচ্ছে।