Friday 7 January 2011

লাগামহীন বাজারে ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষ : চাল আটা তেল পেঁয়াজ চিনির দাম আরও বেড়েছে



সৈয়দ মিজানুর রহমান

এক কেজি মোটা চাল এখন ৩৮ টাকা, খোলা আটা ৩৬ টাকা আর চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। শুধু চাল, চিনি আর আটাই নয়, এক লিটার লুজ সয়াবিনের দাম ঠেকেছে ১০০ টাকায়, পাম অয়েল ৯০ টাকা, পেঁয়াজ ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা। নিত্যপণ্যের এমন চড়া দামে সাধারণ ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। আবার কেউ কেউ চড়া দামে এসব পণ্য কিনতেই পারছেন না। তবে সরকারের দাবি—বাজার নিয়ন্ত্রণেই আছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন
অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর বাজার দর অনুসন্ধান ও গবেষণা সেল সূত্রে জানা গেছে, চাল, চিনি, আটা, ময়দা, তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রেখে যাওয়া বাজার দরকেও টপকে গেছে। এসব পণ্যের দাম গত দুই বছরের ব্যবধানে কোনোটি দ্বিগুণ, আবার কোনোটির দাম তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে।
গতকাল সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি চালের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মোটা চাল (স্বর্ণা বা চায়না ইরি) বিক্রি হচ্ছে ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা কেজি। টিসিবি’র তথ্যমতে, মোটা চালের দাম গত এক বছরে প্রায় ৩২ শতাংশ বেড়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিন ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি বাজারে মোটা চাল ২৭ থেকে ২৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় বলে জানায় টিসিবি।
টিসিবির তথ্যমতে, গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি সাধারণ মানের নাজির ও মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায়। তবে ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি এ মানের চালের দাম ছিল ৩৩ থেকে ৩৮ টাকা। পলাশীমোড় কাঁচাবাজারের চাল ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন জানান, গতকাল খুচরা প্রতি কেজি নাজির ও মিনিকেট বিক্রি হয় ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা। আর উত্তম মানের নাজির ও মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৫১ থেকে ৫৫ টাকা কেজি দরে।
বাজারে এক কেজি খোলা আটার দাম এখন ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। তবে টিসিবি’র দাবি, গতকাল খুচরা বাজারে খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা কেজি। তবে এ মানের আটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিন ২৩ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় বলে জানায় টিসিবি। প্যাকেটজাত আটা বর্তমানে প্রতি কেজি ৩৭ টাকা বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। বাজারে প্রতি কেজি খোলা ময়দার দাম এখন ৩৬/৩৮ টাকা। দুই বছর আগে খোলা ময়দা বিক্রি হয়েছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা দরে। টিসিবি জানিয়েছে, ময়দার দাম এক বছরের ব্যবধানে ১৭ শতাংশ বেড়েছে।
বাজার ঘুরে জানা গেছে, প্রতি লিটার লুজ সয়াবিন তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। টিসিবির হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে লুজ সয়াবিনের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ। সব শেষ গত ২৮ ডিসেম্বর প্রতি লিটার সয়াবিনের দাম ২ টাকা পর্যন্ত বাড়ে বলে জানিয়েছে টিসিবি। তবে ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে লুজ সয়াবিন ৯০ থেকে ৯৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় বলে জানায় টিসিবির বাজার দর অনুসন্ধান ও গবেষণা সেল।
বাজারে পামঅয়েল বিক্রি হচ্ছে এখন প্রতি লিটার ৯০ থেকে ৯৫ টাকা দরে। তবে লুজ পামঅয়েল প্রতি লিটার ৮৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানায় টিসিবি। টিসিবির হিসাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষদিন বাজারে পামঅয়েল বিক্রি হয়েছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকা দরে। পামঅয়েলের দাম এক বছরের ব্যবধানেই প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে বলে জানায় টিসিবি।
২০০৯ সালের শুরুর দিকে বাজারে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৪ টাকা। তবে এখন চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা দরে। অবশ্য টিসিবি বলছে, চিনির দর গত এক সপ্তাহে বেড়ে ৫৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। টিসিবি জানায়, চিনির দর গত এক বছর ধরেই চড়া।
বাজার ঘুরে জানা গেছে, আবার উত্তাপ বাড়ছে পেঁয়াজের বাজারে। পেঁয়াজের দর এক মাসে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। টিসিবি জানায়, গতকাল আরেক দফা দেশি পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। দেশি পেঁয়াজ এখন ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দর ছিল ৩০ থেকে ৩২ টাকা। এ তথ্য টিসিবির। সে সময় আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৩২ থেকে ৩৬ টাকা দরে। টিসিবি জানিয়েছে, আমদানি করা পেঁয়াজের দর অস্বাভাবিক চড়া থাকায় এর ক্রেতা নেই। ফলে গতকাল টিসিবির বাজারদর তথ্যে আমদানি করা পেঁয়াজের মূল্যও স্থান পায়নি।
বাজারে এক কেজি রসুনের দর এখন ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রসুনের দর ছিল ২৪ থেকে ৩২ টাকা কেজি। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত প্রতি কেজি রসুনের দর বেড়েছে ১৫৬ টাকা। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন এটা নজিরবিহীন। তবে রসুনের দর এত অস্বাভাবিক বাড়লেও, এ পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধির কারণ ক্ষতিয়ে দেখেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা।
নিত্যপণ্যের চড়া দর হলেও, সরকারের তরফ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণেই আছে।
খোলা তেল-চিনি বেচা যাবে না : ভোজ্যতেল ও চিনি ব্যবসায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এ দুটি পণ্য বিক্রিতে প্যাকেটজাত বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এ ছাড়া তেল ও চিনি বিক্রি এবং বাজারজাতে ডিও (চাহিদাপত্র) প্রথা তুলে দিয়ে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে পরিবেশক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ভোজ্যতেল ও চিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন এসব সিদ্ধান্তের কথা জানান। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান। বাণিজ্য সচিব সাংবাদিকদের জানান, এ সিদ্ধান্ত এখনও কার্যকর হয়নি। তবে মঙ্গলবার এ নিয়ে বৈঠক হবে। বৈঠকের পর থেকে সার্কুলার জারি করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে। তবে ডিলার অথবা পরিবেশকের মাধ্যমে তা বিক্রি করতে হবে কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি আরও বলেন, ভোজ্যতেল ও চিনি বাজারজাতকরণে প্রচলিত ডিও প্রথা বাতিলের ব্যাপারে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন, অতিরিক্ত সচিব এম মর্তুজা রেজা চৌধুরী, বাংলাদেশ ট্যারিপ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান, আমদানি-রফতানি অধিদফতরের প্রধান নিয়ন্ত্রক এমএ সবুর, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল হোসেন মিয়া, ভোজ্যতেল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি রউফ চৌধুরী এবং ভোজ্যতেল ও চিনি পরিশোধনের মিল মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, কিছু কিছু জটিলতা থাকায় বৈঠকে উত্পাদনকারীরা ডিলারশিপের মাধ্যমে ভোজ্যতেল ও চিনি বিক্রির পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। নিত্যপণ্যের দর চড়া হওয়ার পেছনে পাইকারি, খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদেরও দায়ী করেন বাণিজ্য সচিব

No comments:

Post a Comment