Sunday, 1 January 2012

শুধু প্রতিশ্রুতি উন্নয়ন নেই






আলাউদ্দিন আরিফ
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের তিন বছরের শাসনামলে সারাদেশে উল্লেখ করার মতো কোনো উন্নয়ন হয়নি। বিরোধী দল দমন ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সরকার যতটা মরিয়া ছিল, ততটাই উদাসীন ছিল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে। বড় বড় প্রকল্পের নামে জনসাধারণকে স্বপ্নে বিভোর রাখার যতটা চেষ্টা দেখা গেছে, বাস্তবায়নের উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি তার ছিটেফোঁটাও। অনুন্নয়ন খাতের ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে প্রতি বছরই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-তে কাটছাঁট করা হয়েছে বড় ধরনের। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ, ঢাকায় পাতাল রেল, মনোরেল, সার্কুলার রেলপথ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, গণপরিবহন সমস্যার সমাধান, যানজটমুক্ত ঢাকা উপহার দেয়া, ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার (অরবিটাল) জলপথ তৈরি, টানেল নির্মাণ, চার লেনবিশিষ্ট ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক তৈরি, রেলপথ সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন। কিন্তু এসবের একটি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নও দেখেননি দেশের মানুষ। আগামী দুই বছরেও এগুলো বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
বাস্তবায়িত হয়নি ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ মহাজোটের এমপি প্রার্থীদের দেয়া উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিগুলোও। এসব নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের এমপিরাও এলাকায় চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। এলাকায় গেলে তারা মানুষের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এমপিদের অনেকে মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিচ্ছেন নিজ এলাকার উন্নয়নে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য, কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছেন না।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল—পদ্মা সেতু নির্মাণ, পরিবহন, সড়ক নির্মাণ, গৃহায়ন, বন্দর উন্নয়ন ও নির্মাণে উপযুক্ত নীতিমালা গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক নেটওয়ার্কে গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা সদরকে সংযুক্ত করার কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। এসব প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। সারাদেশের কোথাও এক কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মিত হয়নি গত ৩ বছরে। দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু থেকে অর্থ সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবিসহ দাতা সংস্থাগুলো। এখন পদ্মা সেতু তৈরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। রেলপথ বাড়েনি এক ইঞ্চিও। রেলওয়ের উন্নয়নে ১২টি প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত তার একটিও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
আওয়ামী লীগের ইশতেহারে দেশের চাইতে প্রতিবেশী ভারতের স্বার্থ দেখা হয়েছে বেশি। তাদের ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ‘এশীয় রেল ও জনপথের আওতায় পাশের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপন করা হবে।’ এই ইশতেহার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার নেপালের সঙ্গে রেল ট্রানজিট (পণ্য পরিবহন) ফের চালু করেছে। তবে রেললাইনের উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি। এখন বলা হচ্ছে, ভারতকে করিডোর দেয়ার জন্য ত্রিপুরার আগরতলা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন যোগাযোগ স্থাপন করা হবে।
সারাদেশে ছোট-বড় ৩১০টি নদী। ফারাক্কাসহ ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর ৪২টিতে বাঁধ দেয়ায় দেশের নদীগুলোতে পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে; কমে গেছে নৌপথ। আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি ছিল ‘প্রতিটি ছোট-বড় নদী খনন করা হবে এবং তা যেন সারাবছর নাব্য থাকে তার ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিরাপদে স্বল্প খরচে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য নৌপথের উন্নয়ন ও নৌ পরিবহনের আধুনিকায়ন করা হবে।’ মহাজোটের গত তিন বছরে নদী খননের বড় বড় কয়েকটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে, কিন্তু এর একটিরও বাস্তবায়ন হয়নি।
বাস্তবায়ন হয়নি বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে আধুনিকায়ন করার প্রতিশ্রুতিও। স্থলবন্দরগুলোও আধুনিকায়ন হয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি ভারত সফরকালে সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে করা ৫০ দফা ইশতেহারের ২৩ নম্বর দফায় বাংলাদেশে সড়ক ও রেলপথে ভারত থেকে পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ইশতিহারে ছিল ‘বাংলাদেশ বিমানকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার। আওয়ামী লীগ সরকারের ৩ বছরে মন্ত্রীর বদল হলেও লাভজনক প্রতিষ্ঠান হয়নি বিমান। বাংলাদেশ বিমানে একটি নতুন বিমান সংযোজন ছাড়া গত ৩ বছরে বিমানের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।
জেলাপর্যায়ে এমপিদের যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল সেগুলোও বাস্তবায়তি হয়নি আওয়ামী লীগ শাসনের এই ৩ বছরে। পঞ্চগড় জেলায় স্কুল-কলেজ নির্মাণসহ সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল বাংলাবান্দা স্থলবন্দর চালুর। কিন্তু এই বন্দর চালু করা সম্ভব হয়নি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ সড়ক, জেলা ও উপজেলা পরিষদের রাস্তাসহ সব রাস্তাঘাটেরই বেহাল দশা—খানাখন্দে ভরা। গ্রামীণ জনপদের সড়কগুলো মেরামত না হওয়ায় মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা সড়কটির বেহাল দশার কথা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কালিয়াপাড়া থেকে কচুয়া পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার সড়ক বেশ ক’বছর ধরেই নাজুক। গত ৩ বছরে স্থানীয় এমপি ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের কাছে বার বার ধরনা দিয়েও সড়কটি মেরামত করানো যায়নি। পুরো উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়ার সড়কগুলোরও বেহাল দশা। আশরাফ গ্রামের আবু তালেব মেম্বার জানান, তার বাড়ি থেকে উপজেলা সদর ১৪ কিলোমিটার। এই ১৪ কিলোমিটার রাস্তা বাসে গেলেও শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়।
দিনাজপুরে গত ৩ বছরে জেলা স্কুলের সামনে একটি পাবলিক টয়লেট ছাড়া পুরো জেলায় দৃশ্যমান আর কোনো উন্নয়ন হয়নি। ঠাকুরগাঁওয়ে পানিসম্পদমন্ত্রী থাকার সুবাদে সদর উপজেলার পার্শিদেবীতে রেগুলেটর কাম ব্রিজ নির্মাণাধীন রাবার ড্যাম ও শ্রীপুর কলেজে এক একাডেমিক ভবন ছাড়া তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। সৈয়দপুরে ২০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ ও বিমানবন্দরকে আধুনিয়াকয়নের প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু সেগুলো আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এভাবে দেশের প্রত্যেকটি আসনে আওয়ামী লীগ মহাজোটের এমপিদের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এসব নিয়ে মহাজোটের শরিক এবং আওয়ামী লীগের এমপি—সবাই ক্ষুব্ধ।
গত রোববার মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এই সরকারের দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু হয়নি। পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু দুর্নীতির কারণে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ঘরে ঘরে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। লাখ লাখ টাকা ঘুষ ছাড়া এখন চাকরি হয় না কোথাও। দেশের কোথাও অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন দেখা যায় না।
সম্প্রতি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের এমপি বলেন, অতীতে কী হয়েছে সেটা এখন দেখার বিষয় নয়। আমার সামনে সবচেয়ে বড় কাজ হলো পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করা। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, আমার প্রথম অগ্রাধিকার হবে মানুষের দুর্ভোগ কমিয়ে স্বস্তি নিশ্চিত করা।
এই সরকারের প্রতি এখনও জনগণের বিপুল প্রত্যাশা আছে। হাতে সময় কম হলেও তহবিলের দিকে নজর রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজানো হবে। এই সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক, সময় কম। পথ অনেক, জ্বালানি কম। এর মধ্যেই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

Monday, 19 December 2011

ঘুষ দাবি করায় বিদেশি বিনিয়োগ হলো না




কাদের গনি চৌধুরী
ঘুষ আর দুর্নীতির রাহুগ্রাসে বিনিয়োগকারীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছেন আবার অনেকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন বিনিয়োগ না করে। অভিযোগ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানালেন তারা। বিনিয়োগকারীরা জানান, সরকারি দলের প্রভাবশালীদের শেয়ার ও ঘুষ না দিলে তাদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি ব্যবসা গুটিয়েও চলে যেতে হচ্ছে।
রূপসী বাংলা এয়ারলাইন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল হোসেন প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কানাডা থেকে এসেছিলেন বাংলাদেশে বিমান খাতে বিনিয়োগ করতে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক আফজাল এর আগে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্ বিমান প্রস্তুতকারী সংস্থা বোম্বারডিয়ার এরোস্পেসে বিমান প্রকৌশলী ছিলেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে বার বার বাধাগ্রস্ত হন তিনি। প্রতিটি পদে ঘুষ দাবি করা হয় তার কাছে। নানা বাধা পেরিয়ে ২৯ মে ফিলিপাইন থেকে দুটি বিমান যখন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন তখনই প্রধানমন্ত্রীর দফতরের দোহাই দিয়ে বিনিয়োগ ছাড়াই ২০ ভাগ শেয়ার, এমডি পদ এবং ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। এতে রাজি না হলে নানা হয়রানির পাশাপাশি ব্যবসা পরিচালনায় চরমভাবে বাধা দেয়া হয়। প্রভাবশালী এ মহলটির চাপে সিভিল অ্যাভিয়েশনও তাকে সহযোগিতা করতে অপারগতা প্রকাশ করে। এমনকি সব নিয়মনীতি মেনে বিদেশ থেকে আনা প্লেন দুটি তাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য করে।
হয়রানির বর্ণনা দিয়ে কানাডিয়ান নাগরিক আফজাল হোসেন আমার দেশ-কে বলেন, কেনা বিমান দুটির টেকনিক্যাল ক্লিয়ারেন্সের জন্য সিভিল অ্যাভিয়েশনে আবেদন করলে ডেপুটি ডিরেক্টর এয়ার ক্রাফট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লাইসেন্স মো. গোলাম সারোয়ার মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করেন। এতে আমি সম্মত না হলে নানাভাবে হয়রানি এবং ৫৩ দিন পর টেকনিক্যাল ক্লিয়ারেন্স দেয়া হয়। একই সঙ্গে আমদানি অনাপত্তিপত্র দেয়ার কথা থাকলেও সেটি আটকে রাখেন। আমি আমদানি অনাপত্তিপত্র চাইলে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করা হয়। এতেও আমি সম্মত হইনি। এ ব্যাপারে আমি বার বার চাপ সৃষ্টি করলে অসম্পূর্ণ ও সুস্পষ্ট মতামত ছাড়াই একটি আমদানি অনাপত্তিপত্র বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় সুস্পষ্ট মতামত চেয়ে ফাইল ফেরত পাঠায় সিভিল অ্যাভিয়েশনে। অবশ্য পরে এটি দেয়া হয়। এরপর ফিলিপাইন থেকে কেনা বিমান দুটি পরিদর্শনের জন্য আবেদন করা হলে মো. গোলাম সারোয়ার আবারও ঘুষ দাবি করেন। এবারও আমি সম্মত হইনি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি একসঙ্গে তিনজনকে পরিদর্শনে পাঠান এবং আমি কীভাবে বাংলাদেশে ব্যবসা করি দেখে নেবেন বলে হুমকি দেন। বড় বড় বিমান পরিদর্শনে যেখানে একজনকে পাঠানো হয়, সেখানে ছোট বিমান পরিদর্শনে কেন তিনজনকে পাঠানো হলো—জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমানের ব্যবসা করবেন টাকা খরচ করবেন না, এটা তো হয় না। তিন পরিদর্শক ২০ মে ফিলিপাইনে যান এবং ২৩ মে ফিরে আসেন। পরিদর্শকরা সিভিল অ্যাভিয়েশন এয়ার নেভিগেশন আদেশ অনুযায়ী পরিদর্শনস্থলেই সার্টিফিকেট দেয়ার কথা থাকলেও তা করেননি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিদর্শকরা জানান, উপরের নির্দেশ আছে যেন এখানে কোনো সার্টিফিকেট না দেই। বাংলাদেশে এসে সার্টিফিকেটের জন্য গোলাম সারোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আবারও ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। শুধু তা-ই নয়, পরিদর্শকরা পরিদর্শনকালে তাদের প্রাপ্য টিএ-ডিএ’র চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আদায় করেন। এ ব্যাপারে আমি দুদকে একটি মামলা করেছি। পরে আমি গোপালগঞ্জের সাবেক এক বিমান কর্মকর্তার শরণাপন্ন হই। তিনি আমাকে নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রীর এসএসএফ পরিচয়দানকারী বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার মামুনের কাছে। তিনি আমার কাছে বিনা অর্থায়নে কোম্পানির ২০ ভাগ শেয়ার, এমডি পদ ও ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। এতে আমি রাজি না হলে সিভিল অ্যাভিয়েশনে অত্যন্ত প্রভাবশালী এ দুই ব্যক্তি আমাকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকেন। এমনকি প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেন। একপর্যায়ে আমি উপায় না দেখে বিমানবন্দর থানায় জিডি করি। এরপর তারা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং সিভিল অ্যাভিয়েশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে আমাকে নানাভাবে নাজেহাল করার চেষ্টা করেন।
বিদেশি এই বিনিয়োগকারী জানান, তিনি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট দুটি পরিচালনায় অনুমতির জন্য সদ্যবিদায়ী বিমানমন্ত্রী জিএম কাদের ও সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যানের কাছে বার বার ধরনা দিয়েও কোনো সহযোগিতা পাননি। ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসে তার সারাজীবনের উপার্জন হারাতে বসেছেন তিনি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তিনি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী ও বিমানমন্ত্রীকে লেখা চিঠি : রূপসী বাংলা এয়ারলাইন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল হোসেন প্রধানমন্ত্রী ও বিমানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে বলেন, আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক এবং বর্তমানে কানাডার নাগরিক। গত ২৮ মে ২০০৭ তারিখে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অফিস, বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং কানাডীয় বাংলাদেশ হাইকমিশনের কনস্যুলার (বাণিজ্য) আমাকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমাদের মধ্যে একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে সব ক্ষেত্রে ওয়ানস্টপ সার্ভিসের অঙ্গীকার প্রদান করা হয়েছে। এতে আমি বেশ আশ্বস্ত হই। এর পর আমি আমার গুরুত্বপূর্ণ চাকরি বিশ্বের স্বনামধন্য বিমান নির্মাণকারী সংস্থা বোম্বারডিয়ার এরোস্পেসে বিমান প্রকৌশলীর পদ থেকে পদত্যাগ করি এবং বাংলাদেশে একটি এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠা করি। এয়ারলাইন্সটি ২৩ জুলাই ২০০৮ ইং তারিখে রূপসী বাংলা এয়ারলাইন্স নামে বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে—বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় এবং জেলা থেকে জেলায় ও বিদেশে বিমান পরিচালনার মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা ও বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা। উল্লেখ্য, বর্তমানে শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশি এয়ালাইন্সগুলো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে।
চিঠিতে আফজাল বলেন, আপনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমি গত ৬ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে ফিলিপাইনের অ্যাভিয়েশন এন্টারপ্রাইজ ও সাউথ ইস্ট এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে দুটি বিমান কেনার জন্য খসড়া চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করি। ওই বিমান দুটি কেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশনের বিমানের বয়স সংক্রান্ত এএনও (এ ডব্লিউ) এ/২১, ইস্যু-১ আদেশের ৫.৫ ধারার ৫.৫.২ উপধারা অ্যাজ লিমিট অব এয়ারক্রাফটের নিয়ম অনুসরণ করে কেনা হয়।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি ওই কেনা বিমান দুটির টেকনিক্যাল ক্লিয়ারেন্সের জন্য, এএনও (এ ডব্লিউ) এ/২,ইস্যু-৪ এর ৩ ধারার ৩.৩ উপধারা পূরণসাপেক্ষে সিভিল অ্যাভিয়েশনের ফর্ম সিএ-১৮২সি এবং বিমান দুটির পূর্ণাঙ্গ বিবরণীসহ দুটি আবেদনপত্র, যার স্মারক নং আরবিএ/১৩০৭/ইএনজিজি/বি৭৩৭-৩০০/উ-৪০ এবং ৪১-এর মাধ্যমে আবেদন করি। ওই আবেদনের ৫৩ (তেপান্ন) দিন পর ২৮ মার্চ ২০১১ তারিখ সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে বিমান দুটির টেকনিক্যাল ক্লিয়ারেন্স দেয়। ওই টেকনিক্যাল ক্লিয়ারেন্সে মোট ৪টি কাজ সম্পন্ন করার জন্য ৬০ (ষাট) দিন সময় বেঁধে দেয়া হয়—যা স্বাভাবিকভাবেই ২৮ মে ২০১১ তারিখে শেষ হওয়ার কথা। উল্লেখ্য, এএনও (এডব্লিউ) এ২, ইস্যু ৪-এর ৩ ধারার ৩.৪ উপধারা মোতাবেক অপারেটর/আবেদনকারী যদি কেনা বিমান শুধু টেকনিক্যাল ক্লিয়ারেন্সের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে আনতে চায়, বাংলাদেশ সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে অস্থায়ী সার্টিফিকেট অব রেজিস্ট্রেশন (সি অব আর) ও সার্টিফিকেট অব এয়ার ওরদিনেস (সি অব এ) লাগবে। এটি ছাড়া আনতে হলে আবেদনকারীকে অবশ্যই রফতানিকারী দেশের সার্টিফিকেট অব রেজিস্ট্রেশন (সি অব আর) ও সার্টিফিকেট অব এয়ার ওরদিনেস (সি অব এ)-এর মাধ্যমে বিমান ডেলিভারির (ফেরি ফ্লাইট) ব্যবস্থা করতে হয়। অর্থাত্ কেনা বিমান বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আনার জন্য টেকনিক্যাল সার্টিফিকেটই যথেষ্ট; অন্য বাকি ৪টি শর্ত পূরণের প্রয়োজন নেই। নিয়ম অনুযায়ী ওই টেকনিক্যাল ক্লিয়ারেন্সের সঙ্গে একটি আমদানি অনাপত্তিপত্র (এনওসি ফর ইমপোর্ট) সংযুক্ত করে তা বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর কথা। কিন্তু সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ মো. গোলাম সারোয়ার ওই পত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য পাঁচ লাখ টাকা উেকাচ দাবি করেন। আমি উেকাচ দিতে অস্বীকার করলে তিনি আমদানি অনাপত্তিপত্র (এনওসি ফর ইমপোর্ট) প্রেরণে গড়িমসি করেন। আমি তার এই অসত্ উদ্দেশ্যের কথা বুঝতে পেরে ২৯ মার্চ ২০১১ এবং ৫ এপ্রিল ২০১১ তারিখে পর পর দুটি আবেদনপত্র—যার স্মারক নং আরবিএ/১০০২/ইএনজিজি/ভিওএল-০১/ই-৪১ এবং আরবিএ/১০০২/ইএনজিজি/ভিওএল-০১/ই-৪৩-এর মাধ্যমে আমদানি অনাপত্তিপত্রের (এনওসি ফর ইমপোর্ট) জন্য আবেদন করি, যা প্রয়োজন ছিল না। যেহেতু মো. গোলাম সারোয়ারের কথামত আমি তাকে পাঁচ লাখ টাকা উেকাচ দিতে অস্বীকার করি এবং পর পর দুটি পত্র লিখি, তাই তিনি অসম্পূর্ণ এবং সুস্পষ্ট মতামত ছাড়াই একটি আমদানি অনাপত্তিপত্র বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ৭ এপ্রিল ২০১১ তারিখে পাঠান।
২৫ এপ্রিল ২০১১ তরিখে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে উল্লিখিত আমদানি অনাপত্তিপত্রটি ফ্যাক্সের মাধ্যমে সিভিল অ্যাভিয়েশনে ফেরত পাঠান এবং সুস্পষ্ট মতামত ও সুপারিশসহ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পাঠানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু মো. গোলাম সারোয়ার ওই ফ্যাক্সে পাঠানো পত্রটি গোপন করে রাখেন এবং মেইলের মাধ্যমে মূল পত্রটি তার কাছে আসার অপেক্ষায় গড়িমসি করতে থাকেন। এ ব্যাপারে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এম সাইদুল হাসান খানের (সদস্য পরিচালনা ও পরিকল্পনা) কাছে ফ্যাক্সে আসা পত্রটি গোপন রাখেন। পত্রটি মন্ত্রণালয় থেকে আসার ৮ দিন পর অর্থাত্ ৩ মে ২০১১ তারিখে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সংশোধিত আমদানি অনাপত্তিপত্র বিমান মন্ত্রণালয়ে পাঠান।
এরপর ফিলিপাইনে অবস্থিত আমার কেনা উড়োজাহাজ দুটি পরিদর্শনের জন্য ৭ এপ্রিল ২০১১ এবং ২৬ এপ্রিল ২০১১ তারিখে যথাক্রমে স্মারক নং আরবিএ/১০০২/ইএনজিজি/ভিওএল-০১/ই-৪৫ এবং ৪৬-এর মাধ্যমে পরিদর্শক নিয়োগের আবেদন করি। কিন্তু মো. গোলাম সরোয়ার পরিদর্শক নিয়োগের জন্য আবারও মোটা অঙ্কের উেকাচ দাবি করেন। আমি উেকাচ দিতে অস্বীকার করায় আবেদনের ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) দিন পর অর্থাত্ ১২ মে ২০১১ তারিখে ছোট ছোট দুটি বিমান পরিদর্শনের জন্য তিনি ৩ জন পরিদর্শক নিয়োগ করেন—যা বাংলাদেশের সিভিল অ্যাভিয়েশনে নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগে কখনও বড় বড় বিমান পরিদর্শনেও তিনজন পরিদর্শক নিয়োগের নজির নেই। অথচ আমার মাত্র ১৯ আসনবিশিষ্ট দুটি বিমান পরিদর্শনের জন্য তিনজন পরিদর্শককে ৪ দিনের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন অরগানাইজেশনের নিয়ম অনুযায়ী যা একজন পরিদর্শকের দুই দিনের কাজ। অথচ সিভিল অ্যাভিয়েশন লোকবলের স্বল্পতা দেখিয়ে অন্যান্য কাজে বিলম্ব ঘটায়। ওই পরিদর্শকদের টিএ-ডিএ দেয়ার হিসাব ও তাদের পাসপোর্টে বৈদেশিক মুদ্রা এনডোর্সমেন্ট করার জন্য ১৯ মে ২০১১ তারিখে স্মারক নং আরবিএ/১০০৩/এডমিন/ভিজিট/ভিওএল-০১/ই-২-এর মাধ্যমে একটি আবেদন করি। কিন্তু উইং কমান্ডার মাহমুদুল হাসান (ডিএফএসআর) আমার প্রশাসনিক পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন দেলোয়ার হোসেনকে (অব.) ওই আবেদনের জন্য হীন মানসিকতা বলে তিরস্কার করেন এবং প্রত্যেক পরিদর্শককে ৮২০ (আটশ’ বিশ) মার্কিন ডলার করে নগদে পাসপোর্টে এনডোর্সমেন্ট না করে প্রদানের মৌখিক নির্দেশ দেন—যা একজন সরকারি কর্মকর্তার মুখ থেকে শোনা এক বিদেশি বিনিয়োগকারীর জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে স্মারক নং আরবিএ/১০০২/ইএনজিজি/ভিওএল-০১/ই-৫৩-এর মাধ্যমে ওই ৮২০ (আটশ’ বিশ) ডলার করে নেয়ার তিনটি বিল দস্তখতের জন্য সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করি। কিন্তু অদ্যাবদি বিলগুলো দস্তখত করে আমাকে ফেরত দেয়া হয়নি।
২০ মে থেকে ২৩ মে ২০১১ তারিখ পর্যন্ত পরিদর্শকরা বিমান দুটি ফিলিপাইনে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শকদের যাতায়াত খরচসহ সব খরচ আমি বহন করি। ওই পরিদর্শকরা সিভিল অ্যাভিয়েশনের এয়ার নেভিগেশন আদেশ এএনও (এ ডব্লিউ) এ/২১, ইস্যু-৪ প্যারা-৯, সাব-৭ অনুযায়ী পরিদর্শন এবং এএনও (এ ডব্লিউ) এ/২, ইস্যু-৪ প্যারা-৩, সাব-৩.৮ অনুযায়ী পরিদর্শনস্থলেই সার্টিফিকেট দেয়ার কথা। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া তারা সেখানে তা না দিয়ে বাংলাদেশে এসে দেয়ার ব্যাপারে উপরের নির্দেশ আছে বলে জানান। উল্লেখ্য, এএনও(এ ডব্লিউ) এ/২, ইস্যু-৪ প্যারা-৯, সাবপ্যারা-৯.৩ অনুযায়ী নিয়োগকৃত পরিদর্শকরা কেউই বিমান দুটি পরিদর্শনের যোগ্যতা রাখেন না; কারণ ওই পরিদর্শকদের কেউই ওই বিমান দুটির সঙ্গে মোটেও পরিচিত নন। বাংলাদেশে আসার পর তাদের (পরিদর্শকদের) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা মো. গোলাম সরোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে আমি মো. গোলাম সরোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দশ লাখ টাকা উেকাচ দাবি করেন। ওই টাকার পাঁচ লাখ টাকা তাদের সবার এবং বাকি পাঁচ লাখ টাকা ডিরেক্টর ফ্লাইট সেফটি এবং রেগুলেশন উইং কমান্ডার মাহমুদুল হাসানকে দেবেন বলে জানান। আমি উেকাচ দিতে অস্বীকৃতি জানাই। যেহেতু আমাকে বিমান দুটি পরিদর্শন সম্পর্কে কিছুই অবগত করা হয়নি, তাই এএনও (এ ডব্লিউ) এ/২,ইস্যু-৪ প্যারা-৩, সাবপ্যারা-৩.৪ মোতাবেক বিমান দুটি ডেলিভারি গ্রহণের ব্যবস্থা করি এবং ২৫ মে ২০১১ তারিখে স্মারক নং আরবিএ/১০০২/ওপিএস/জিইএন/ই-৪৩-এর মাধ্যমে সম্ভাব্য সময়সূচি জানিয়ে একটি পত্র সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করি।
২৯ মে ২০১১ তারিখ অর্থাত্ ওই আবেদনের চার দিন পর আমার কেনা দুটি বিমানের একটি বিমান চট্টগ্রামের শাহ্ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি নিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে অবতরণ করে। অবতরণের পর বিমানটি জ্বালানি গ্রহণ করে এবং ঢাকার উদ্দেশে রওনার জন্য কন্ট্রোল টাওয়ারে যোগাযোগ করতে গেলে কর্তব্যরত কর্মকর্তা ঢাকায় অবতরণের অনুমোদন নেই বলে ওই বিমানের পাইলটকে অবহিত করেন। আমি বিষয়টি অবগত হই বিমানটি যখন জ্বালানি গ্রহণ করছিল। জ্বালানি ট্রাকের এক ব্যক্তি তার সেলফোন থেকে আমাকে কল করেন এবং জ্বালানির পেমেন্ট সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন। এরপর পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি, আমার কেনা বিমানটি এবং তার ক্রুদের সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ আটক করেছে এবং ক্রুদের মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে—যা আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনের শিকাগো কনভেনশন ৭ ডিসেম্ভর ১৯৪৪ সালের চ্যাপ্টার ২-এর আর্টিকেল ৫ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছে।
আমি বিষয়টি পরিষ্কার করে জানার জন্য সিভিল অ্যাভিয়েশনে যাই এবং ডাইরেক্টর ফ্লাইট সেফটি ও রেগুলেশন উইং কমান্ডার মাহমুদুল হাসাসের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে চাইলে তিনি সাক্ষাত্ দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে আমি বিষয়টি নিয়ে চেয়ারম্যান, সিভিল অ্যাভিয়েশনের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে চাইলে পিএসটু চেয়ারম্যান তিরস্কারের স্বরে বলেন, আমি কেন এখানে এসেছি এবং চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে দেখা করার প্রশ্নই ওঠে না এবং চেয়ারম্যান সাহেব দেখা করার জন্য মোটেও আগ্রহী নন। পরে ২ জুন ২০১১ তারিখে ওই বিমান ও তার ক্রুদেরকে জোর করে চট্টগ্রাম শাহ-আমানত বিমান বন্দর থেকে উড্ডয়ন করে ফেরত পাঠানো হয়। ফলে রূপসী বাংলা এয়ারলাইন্স আর্থিকভাবে অভূতপূর্ব ক্ষতির সম্মুখীন হয়—যার পরিমাণ প্রায় ষোল কোটি টাকা। এছাড়া বিমানগুলোর ভ্যালিড এয়ার ওরদিনেস সার্টিফিকেট ছিল না বলে উইং কমান্ডার মাহমুদুল হাসান (ডিএফএসআর) যে অসত্য তথ্যসংবলিত বিবৃতি মিডিয়ায় দিয়েছেন তাতে রূপসী বাংলা এয়ারলাইনসের ভাবমূর্তি জনসম্মুখে দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, যা অপূরণীয়।
এরপর আবারও ৪ জুন ও ৭ জুন ২০১১ তারিখে স্মারক নং আরবিএ/১০০২/ওপিএস/জিইএন/ই-৪৯ এবং ই-৪৪-এর মাধ্যমে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে, ২০ জুলাই ২০১১ তারিখে সচিব মহোদয়ের কাছে এবং ১৪ আগস্ট ২০১১ তারিখে মাননীয় মন্ত্রী, বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারক নং আরবিএ/১০০২/ওপিএস/জিইএন/ই-৫২ এর মাধ্যমে পৃথক পৃথক আবেদন করি, কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো আবেদনেরই কোনো জবাব অদ্যাবধি আমি পাইনি বা কেউই আমাকে তলব বা কোনো প্রশ্ন করেনি। তাই আমি বাধ্য হয়েই অন্যায় আবদার, অবিচার, কর্তব্যের প্রতি অবহেলা এবং দেশের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে এহেন চক্রের হাত থেকে রক্ষার জন্য ও সুবিচারের আশায় গত ৩১ জুলাই ২০১১ তারিখে মহামান্য বিজ্ঞ ঢাকা মহানগর দায়রা ও সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে মেট্রো স্পেশাল মামলা নং ২৬৩/২০১১ দায়ের করি। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে গত ১৬ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে একটি, ২৩ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে দুইটি, ২৪ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে একটি, ২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে একটি, ২৪ আগস্ট ২০০৯ তারিখে একটি, ৫ নভেম্বর ২০০৯ তারিখে একটি, ৩০ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে একটি, ১ জুলাই ২০১০ তারিখে একটি, ২৯ মার্চ ২০১১ তারিখে একটি, ২৪ এপ্রিল ২০১১ তারিখে তিনটি, ১৫ মে ২০১১ তারিখে একটি, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে একটি, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে একটি, এ বছরের ২৩ অক্টোবর একটি এবং ২৫ অক্টোবর একটি পত্র সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখি যার কোনো উত্তর বা কার্যক্রম অদ্যাবধি আমাকে অবহিত করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি : রূপসী বাংলা এয়ারলাইন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, তিনি বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। এ ব্যাপারে সরকার সহযোগিতা না করলে তিনি আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হবেন।
সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য পাওয়া গেল না : এ ব্যাপারে সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান মাহমুদ হুসাইনের বক্তব্য জানার জন্য তার মুঠোফোনে বার বার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। সিভিল অ্যাভিয়েশনের ডেপুটি ডিরেক্টর এয়ার ক্রাফট ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড লাইসেন্স মো. গোলাম সারোয়ারকে তার মোবাইলে ফোন করলে তিনি পরিচয় জানতে চান। পরিচয় দেয়ার পর তিনি বার বার হ্যালো হ্যালো বলে জানান—ভাই ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করলে একই কথা বলেন। এরপর তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2011/12/12/121867

Wednesday, 23 November 2011

শিশু ধর্ষণ বাড়ছে : ৩৪ মাসে ১৬০০ নারী ও শিশু ধর্ষিত

নাছির উদ্দিন শোয়েব

ঈশারাত জাহান ইভা। ছয় বছরের স্কুলছাত্রী। কোরবানির ঈদের ছুটিতে মামার বাসায় বেড়াতে এসেছিল অবুঝ শিশুটি। ঈদের আগের রাতে টেলিভিশনে কার্টুন দেখার সময় পাশের বাসার ভাড়াটে জাকির শিশুটিকে ফুঁসলিয়ে ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে যায়। ধর্ষণ করে শিশুটিকে। তার পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে জাকির। এমনকি লাশের পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয় তার শরীরে। ঈদের দিন সকালে বাড়ির পাশের ডোবায় ইভার মৃত দেহ ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর খিলক্ষেতের নামাপাড়া এলাকায়। পরে র্যাবের হাতে গ্রেফতার জাকির শিশুটিকে অপহরণ ও ধর্ষণের পর নির্যাতনের কথা স্বীকার করে।
ঈদুল আজহার আগের রাতে নগরীর হাজারীবাগ এলাকায় সাত বছরের একটি শিশুকে সুলতানগঞ্জ এলাকার এক যুবক ধর্ষণ করে। এ কথা কাউকে বললে হত্যারও হুমকি দেয়া হয়। পরে বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় থানায় মামলা হয় এবং শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে স্থানীয় লোকজন ও কয়েকটি নারী অধিকার সংগঠন।
প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। কোনোটি মিডিয়ায় প্রচার
হয়, অনেক ঘটনা থেকে যায় আড়ালে। মান-সম্মানের কথা বিবেচনা করে এসব ঘটনা অনেকেই প্রকাশ করতে কিংবা মামলা করতে চায় না। পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বর্তমান সরকারের ৩৪ মাসে সারাদেশে প্রায় ১৬শ’ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫৮৩ নারী-শিশু। গণধর্ষণ করা হয়েছে ৪০৩ জনকে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২১০ জনকে। অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ৪৪ জন। তবে এ পরিসংখ্যানের চেয়ে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। ধর্ষণের প্রকৃত ঘটনা পরিসংখ্যানের কয়েকগুণ—বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
গত ২৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের এক রায়ে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি থানায় আলাদা সেল গঠন করতে হবে। এক মাস পর পর যৌন হয়রানির মামলার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে থানা সেল। কিন্তু গত ১০ মাসেও আদালতের এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি।
ক্রমেই নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে চলছে। শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরাও। ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড ও লাশ গুম করার ঘটনাও ঘটছে। পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে নারীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটছে। সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। ফরেনসিক পরীক্ষার ঝামেলা, আলমত সংগ্রহ এবং অভিযুক্তকে পুলিশের কাছে উপস্থিত হতে বাধ্য করায় অনেকেই লোকলজ্জায় ঘটনা এড়িয়ে যেতে চায়। থানায় মামলা হলেও গ্রেফতার হয় না অপরাধী। কেউ গ্রেফতার হলেও মামলা বেশি দূর এগোয় না। প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীনদের হুমকি, কখনও তাদের মধ্যস্থতায় মীমাংসা করতে বাধ্য হয় অভিযুক্তরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, নিরাপত্তার অভাবে অনেকে নির্যাতিত হয়েও মামলা করতে ভয় পায়। আবার অনেক মামলায় আসামি পক্ষের ভয়ে মানুষ সাক্ষ্য দিতে চায় না। এর ফলে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক সময় অপরাধীরা আদালত থেকে পার পেয়ে যায়। এজন্য ভিকটিম অ্যান্ড উইটনেস প্রটেকশন অ্যাক্ট নামে নতুন একটি আইন করা হচ্ছে বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গত ১০ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭৩ জন। এর মধ্যে শিশু ৩৮৫ জন, এ ঘটনায় খুন ৫১ জন, গণধর্ষণ ১০৮ জন ও আত্মহত্যা করেছে ৩০ জন। ২০১০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৫৬ জন, শিশু ৩০৮ জন, হত্যা করা হয় ৬১ জনকে, গণধর্ষণের শিকার ১১৯ জন ও আত্মহত্যা করেছে ৬ জন। ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৫৪ জন, শিশু ২৪৩ জন, হত্যা ৯৭ জন, গণধর্ষণ ১৭৬ জন ও আত্মহত্যা করেছে ৮ জন।
কিছুদিন আগে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখায় এক ছাত্রীকে কোচিং সেন্টারে আটক করে শ্লীলতাহানির ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষক পরিমলকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে ওই শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করার কথা স্বীকার করে। অন্যদিকে ঢাকা সিটি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী শামীমা নাসরিন সুইটিকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় নিহত ছাত্রীর বাবা আলাউদ্দিন খন্দকার মেয়ের কথিত মামাবেশী প্রেমিক সাইফুল ইসলাম রনিসহ তিনজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। পুলিশ এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খোকন নামে একজনকে আটক করে। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, সুইটিকে ৪-৫ জন মিলে ধর্ষণ করে। ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য হত্যার পর আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়। খিলক্ষেত থানার ওসি শামীম হোসেন বলেন, নিহত ছাত্রীর সঙ্গে আসামি সাইফুল ইসলামের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের জন্য চাপ দেয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।
গত ৩১ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড়ের সি-ব্লকের ১২/৬ বাড়ির চতুর্থ তলায় মডেল আদৃতাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। তার প্রেমিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আশিষ কর্মকারকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গত সেপ্টেম্বরে রাজধানীর আদাবর মাঠখোলা মহল্লায় এক কিশোরী (১৫) গণধর্ষণের শিকার হয়। ওই কিশোরীর মা আমেলা বেগম অভিযোগ করেন, রাত সাড়ে ৮টায় তার মেয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে আদাবরে বাসায় ফিরছিল। ওই সময় স্থানীয় বখাটে শুকুর আলী তিন সহযোগীসহ মেয়েকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। তারা সবাই মিলে মাঠখোলার ফাঁকা একটি স্থানে তার ওপর নির্যাতন চালায়। আশপাশের লোকজন টের পেলে ধর্ষকরা পালিয়ে যায়। এরপর কিশোরীকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে গভীর রাতে ঢামেক হাসপাতালের ওসিসিতে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। কিছুদিন পরই মোহাম্মদপুরে পুলপার বটতলার একটি বাসায় অপর কিশোরী (১৪) ধর্ষণের শিকার হয়।
গত ২ জুন গাজীপুরের টঙ্গীতে এক তরুণী রাতে ঘরের বাইরে গেলে বাড়িওয়ালার ছেলে মইনুদ্দিন ও তার কয়েক সহযোগী তাকে ধর্ষণ করে এবং পরে তরুণীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। গুরুতর অবস্থায় মেয়েটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ৫ জুন মারা যায়। এছাড়া বাগেরহাটে প্রথম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে প্রতিবেশী। অপরদিকে, মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার ভাবনপাড়া প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভজন কুমার শিকদার ৫ম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। এ অভিযোগে তিনদিন পর থানায় মামলা হয়। এদিকে, গত শবেবরাত রাতে গাজীপুরে ধর্ষণের শিকার ৬ বছরের এক শিশু ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ ঘটনায় জনতা ধর্ষক জুয়েলকে আটক করে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেয়।
গত ১৬ অক্টোবর রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায় শারমীন (১০) নামের স্কুলছাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। আগের দিন সকাল থেকে সে নিখোঁজ ছিল। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ বলছে তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ১৫ অক্টোবর এক কলেজ ছাত্রী সাতক্ষীরা শহরে বেড়াতে আসেন। বিকালে বাড়ি ফেরার সময় তার সঙ্গে দেখা হয় তাদের পারিবারিকভাবে পরিচিত দেবাহাটা থানার পুলিশ কনস্টেবল সালাউদ্দিনের সঙ্গে। সালাউদ্দিন কলেজ ছাত্রীকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে সাতক্ষীরা শহরের শাপলা হোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় পুলিশ কনস্টেবল সালাউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জে এক গৃহবধূকে ঋণ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে ঘরে আটকে রেখে পাশবিক অত্যাচার চালায় ও তার নগ্ন ছবি তুলে তা প্রচার করে মোরেলগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন স্থানীয় নেতা।

Monday, 31 October 2011

শ্রমজীবী মানুষ দিশেহারা : দ্রব্যমূল্য বাসাভাড়া চিকিত্সা ও পরিবহনব্যয় নাগালের বাইরে



আলাউদ্দিন আরিফ
রিকশা-ভ্যানচালক আবুল হাশেমের মাসিক আয় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। তিন বছর আগে এর অর্ধেক টাকা রোজগার করেও আটজনের সংসার তিনি একাই চালিয়েছেন। এখন ভ্যানের ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু এ আয়েও এখন তিনি আর সংসার চালাতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে তার স্ত্রী খিলগাঁও তিলপাপাড়ায় দুটি বাসায় বুয়ার কাজ করেন। এ মাসে মেজো মেয়েটিকে কাজ দিয়েছেন সুতার ফ্যাক্টরিতে। এখনও বেতন ধরেনি কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে স্বামী-স্ত্রীর আয় প্রায় ১১ হাজার টাকা। আয় আগের তুলনায় বাড়লেও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়নি একচুলও। বরং কমেছে। বেড়েছে সংসারে অভাব-অনটন আর অশান্তি। পরিবার-পরিজন নিয়ে খিলগাঁও তিলপাপাড়া বক্সকালভার্ট সড়কের পাশে টিনের ঘরটিতে থাকছেন ৬ বছরের বেশি সময় ধরে। উঠে ছিলেন ৭০০ টাকা ভাড়ায়। এখন সেই বাড়ির ভাড়াই দিচ্ছেন সাড়ে তিন হাজার টাকা। কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার আড্ডা গ্রামের বাসিন্দা আবুল হাশেম বলেন, ‘চাইর বছর আগেও দিনে ত্রিশ টিয়া (টাকা) দামের হোয়ার (সোয়া কেজি) চাইল, আর ত্রিশ-চল্লিশ টাকার তরিতরকারি (শাকসবব্জি) কিনলে ভালামতন খাওন যাইত। কিন্তু অনে দিনে তিনশ’ টেয়ায়ও সারে না। হোয়ার চাইলে যায় ষাইট টিয়া, একশ’ টিয়ার তরতরকারি কিনলে একদিন চলে না।’ বয়স পঞ্চাশে পড়া হাশেম বলেন, স্যার আমরা বাইচমু কেমনে।’
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আবুল হাশেমের মতোই অবস্থা নগরীর নিম্নআয়ের মানুষের। সবারই একটা প্রশ্ন—আমরা বাঁচব কী করে? গতকাল খিলগাঁও রেলক্রসিংয়ের নিচে নিজের ভ্যানের ওপর বসে জিরিয়ে নেয়ার সময় হাশেম বলেন, বড় মেয়েটাকে গত বছর বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের সময় গ্রামের বাড়িতে কিছু জমি বন্ধক দিয়ে ও ঢাকায় এসে ভ্যান চালিয়ে সঞ্চিত চল্লিশ হাজার টাকা যৌতুক দিয়েছেন মেয়ের জামাইকে। কিন্তু এখন মেয়ের স্বামী একটা ক্যামেরা মোবাইল সেট চায়। মোবাইল না দেয়ায় মেয়েকে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে, মোবাইল না নিয়ে যাতে স্বামীর ঘরে না যায়। আবুল হাশেম কী করে টাকা জমিয়ে একটা মোবাইল কেনা যায় সেই চিন্তায় অস্থির।
ঢাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য আর বাসা ভাড়া। এ দুটির লাগাম টেনে ধরতে পারছে না কেউ। সেই সঙ্গে বেড়েছে বাস ভাড়া, রিকশা ভাড়া, শিক্ষা ও চিকিত্সা ব্যয়। ফলে সীমিত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ আছেন চরম বিপাকে। বাড়তি খরচের ধাক্কা আসছে বাড়িওয়ালা, সবজিওয়ালা, দোকানদার, রিকশাওয়ালাদের কাছ থেকেও। বাসায় গেলে বাড়িওয়ালার দাপট, বাজারে বিক্রেতার দৌরাত্ম্য, রাস্তায় রিকশা গাড়ির দৌরাত্ম্য। সবদিক থেকেই বেসামাল নগরজীবন। তেল-গ্যাসের ভর্তুকি কমানোর অজুহাতে দফায় দফায় জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি মানুষের জীবনে বিরাজমান অভাবকে আরও তীব্র করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না মানুষ। এতে অভাব-অনটন বাড়ার পাশাপাশি যৌতুকের দাবিতে বাড়ছে নারী নির্যাতন। দেখা দিচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা।
নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবজি, মাছ, মাংস, চাল ও তেলসহ সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষের সংসারের চাকা এখন চলছে না। অর্থনীতির হিসাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ঠেকেছে ১২ শতাংশের বেশি। সীমিত আয়ের মানুষের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বড় ধাক্কা লেগেছে দিনমুজুর থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তের জীবনেও। বাজারে ভালো মানের চাল কেজিপ্রতি ৪৫ থেকে ৬০ টাকা। মোটা চাল মিলছে না ৩৬ টাকার কমে। ওএমএসের চালের দামও ২৪ টাকা কেজি। চাল নিয়ে ওএমএসের ট্রাক এখন আর যায় না স্পটগুলোতে। সাধারণ মানুষ বলছেন, গত রমজানের আগ পর্যন্ত শাকসবজির দাম ক্রেতার নাগালের মধ্যে ছিল। তখন সবজি দিয়ে অন্তত দু’বেলা ভাত খেতে পেরেছে মানুষ। কিন্তু সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর ওই সুযোগও আর নেই। এখন সবজির দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, ক্রেতারা সবজির দোকানে যেতেও ভয় পান। পেঁপে আর আলু ছাড়া বাজারে ৫০ টাকার কমে কোনো সবজি নেই। তাহলে মানুষ খাবে কী?
খিলগাঁও শাহজাহানপুরে একটি ফার্নিচার দোকানের পলিশ মিস্ত্রি চাঁনমিয়া। রোজ মজুির নেন ৪০০ টাকা। দু-আড়াই বছর আগে মজুরি নিতেন ২০০ টাকা। মাত্র দু’বছরে বলা যায় তার আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। বাজারে জিনিসপত্রের দাম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রথমেই চাঁনমিয়া বলেন চাল, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, ডাল ইত্যাদির কথা। মোটা চালের দাম ১৮ থেকে ৪০ টাকা। পেঁয়াজ ১৬ থেকে ৪০-৪২ টাকা, কাঁচামরিচের দাম ৪০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। আগে বাড়িভাড়া দিতেন ১২শ’ টাকা। এখন দেন ৩২শ’ টাকা। চাঁনমিয়া বলেন, তাদের কাজ রোজ হিসেবে। কোনোদিন কাজ থাকে কোনোদিন থাকে না। তারপরও সপ্তাহে একদিন মার্কেট থাকে বন্ধ। এছাড়াও হরতালসহ বিভিন্ন কারণে মাসে আরও এক-দু’দিন মার্কেট বন্ধ থাকে। সব মিলিয়ে মাসে গড়ে ১৫ থেকে ১৮ দিন কাজ করেন। মাসের বাড়িভাড়া, বিদ্যুত্ বিল, খাবার খরচসহ অন্যান্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে অসম্ভব আর্থিক টানাটানিতে পড়ছেন। প্রতি মাসেই ঋণ করতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ডাচবাংলা ব্যাংকের টিএসসি বুথের গার্ড মোয়াজ্জেম জানালেন, দৈনিক ডিউটি ৮ ঘণ্টা। বেতন ৩ হাজার ৬০০ টাকা। এ সামান্য বেতনে চলেন কী করে উত্তরে বলেন, রোজ একটি ওভারটাইম পান তারা। অর্থাত্ ৮ ঘণ্টার স্থলে ডিউটি করতে হয় ১৬ ঘণ্টা। এতে মাসে তার সাকুল্যে আয় হয় ৭ হাজার টাকা। মোয়াজ্জেম জানালেন, কিছুদিন আগেও বেতনের টাকায় থাকা-খাওয়া সেরে ওভারটাইমের টাকাগুলো বাড়িতে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু এখন সেটা পারছেন না। ওভারটাইমেরও অর্ধেক টাকা খরচ হয়ে যায় থাকা-খাওয়া আর পকেট খরচ বাবদ। বাড়িতে মাসে হাজার দুয়েক টাকা পাঠানো মুশকিল হয়ে পড়ে তার।
খিলগাঁওয়ের গৃহবধূ তাহমিনা বেগম বলেন, তার স্বামী দু’বছর আগে যে বেতন পেতেন এখনও তাই পাচ্ছেন। নানা জটিলতায় অফিসে তার স্বামীর বেতন বাড়ছে না। স্বামীর বেতন প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আগে মোটামুটিভাবে মাসের খরচ শেষে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারতেন। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হয় না। প্রতি মাসেই অভাবে পড়তে হয়। উদাহরণ দিয়ে বলেন, এই দু’বছরে বাসাভাড়া বেড়েছে ২ হাজার টাকা। বিদ্যুত্ ও ডিশলাইনের বিল বেড়েছে প্রায় চারশ’ টাকা। এর বাইরে তাদের একমাত্র মেয়েকে আগে ডাক্তার দেখিয়ে যেখানে ডাক্তারি ফি দিতেন ৩০০ টাকা, এখন তা দিতে হয় ৬০০ টাকা। গত কয়েক বছরে শিশুর দুধসহ অন্যান্য শিশুখাদ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘এক কেজি ডিপ্লোমা গুঁড়ো দুধ দুই বছর আগে কিনতাম ৩৬০ টাকায় এখন কিনতে হচ্ছে ৫৭০ টাকায়। ৩০ টাকা কেজির চিনি হয়েছে ৭০ টাকা। ৫ টাকা দামের একটি চকোলেটের দাম হয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। আগে মিনিকেট চাল কিনতেন, এখন কিনছেন স্বর্ণা। মাছ-মাংস কেনা কমিয়েছেন। কিন্তু একমাত্র মেয়ে কিছু চাইলে তো আর না দিয়ে পারা যায় না। দাম যতই বাড়ুক নিজে না খেয়ে হলেও অন্তত বাসা ভাড়া আর সন্তানের খাবারের টাকা তো জোগাড় করতে হয়। তার ওপর গ্রামের বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়িকে টাকা পাঠাতে হয়, তাদের চিকিত্সা ও ওষুধ কিনে দিতে হয়। এসব করতে গিয়ে প্রতি মাসেই ঋণ করতে হচ্ছে। সঞ্চয় আগেই শেষ। মাসের ঋণ মাসে পরিশোধ করতে না পারায় এখন আত্মীয়স্বজনের কাছে ঋণ চাইলেও পাওয়া যায় না। বিভিন্ন অজুহাতে নিষেধ করে দেন। তাহমিনা বলেন, রিকশাচালক রিকশাভাড়া বাড়াতে পারে, বাড়িওয়ালা ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারে কিন্তু আমাদের মতো চাকরিনির্ভর মানুষ ইচ্ছে করলেই বেতন বাড়িয়ে নিতে পারেন না। ফলে এ ঊর্ধ্বগতির বাজারে নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ দূরে থাক—বেঁচে থাকাটাই দায় হয়ে পড়েছে।
গতকাল মালিবাগ বাজারের পাশে ওএমএসের চাল কেনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সুরাইয়া, হাফসা ও মরিয়মসহ কয়েকজন। বেলা তখন সাড়ে ১২টা। তাদের একজন সুরাই খা সে অসুস্থতার কথা বলে গার্মেন্ট থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। ওই সময়েও ওএমএসের ট্রাক আসেনি। এলে সবার আগে লাইনে দাঁড়াবেন এজন্য অপেক্ষা। তারা জানান, প্রায়ই ট্রাক আসে না। অপেক্ষমাণ এসব মানুষ বলেন, তিন বছর আগেও মোটা চাল কিনতেন সতের আঠার টাকা কেজিতে। আর এখন সরকারি ওএমএসের মোটা চালও কিনতে হয় ২৪ টাকা কেজিতে। বাজার থেকে কিনতে হয় ৩৮ টাকায় অর্থাত্ চালের দাম বেড়েছে আড়াইগুণ। সুরাইয়া বলেন, তিন বছর আগে তিনি গার্মেন্টে সুইং অপারেটর হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন মাত্র এক হাজার টাকা বেতনে। এখন সেই বেতন হয়েছে সাড়ে চার হাজার টাকা। কিন্তু সুরাইয়ার ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি এই বাড়তি বেতনে। কারণ তার মেসের খরচ, চাল ডালের খরচ দিয়ে বাড়িতে এক হাজার টাকা পাঠানো খুবই দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
কারওয়ান বাজারে একটি বেসরকারি অফিসে অফিস সহকারী শামসুদ্দীন মিয়া। বাসা ঢাকার মানিকনগর এলাকায়। ৫ ছেলে তার। নিজে বেতন পান ৫ হাজার টাকা মাসে। তিন ছেলে কর্মজীবী। এক ছেলে অন্য একটি অফিসে অফিস সহকারী। দুই ছেলে দোকান চালায়। আর ছোট দুই ছেলে পড়ছে। বাবা ও ৩ ছেলের আয় মাসে প্রায় ১৬ হাজার টাকা। মেস বাসাভাড়া দেড় হাজার, প্রত্যেকের খাওয়া খরচ মাসে প্রায় ২ হাজার। এসব খরচ মিটিয়ে মাসে হাজার তিনেক টাকা বাড়িতে পাঠানো দুষ্কর হয়ে পড়ে শামসুদ্দীন মিয়ার।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর সরকারি চাকরি করে কয়েক বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আনোয়ার উল্লাহ। তিনি অবসর নেয়ার সময় সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন মোট ১৬ লাখ টাকা। পুরো টাকা দিয়েই তিনি জাতীয় সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন। যা থেকে তিন বছর আগেও ১৪ শতাংশ হারে সুদসহ মাসে ২০ হাজার টাকা পেতেন। বর্তমানে সরকার এই সুদের হার কমিয়ে ১২ শতাংশ করেছে। তার ওপর সুদের ওপর ট্যাক্স বসিয়েছে। ফলে আনোয়ার উল্লাহর সংসারের আয় কমে গেছে। পেনশনের চার লাখ টাকা ছেলেকে দিয়েছেন শেয়ারবাজারে খাটানোর জন্য। কিন্তু তার ছেলে এরই মধ্যে দুই লাখ টাকা লোকসান করেছে। একদিকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমে গেছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজারে ছেলের লোকসান। সব মিলিয়ে আনোয়ার উল্লাহর সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা। তিনি বলেন, শুধু চাল, ডাল, মাছ ও তরকারি দাম বেড়েছে তাই নয়; সাবান, কসমেটিকসসহ এমন কোনো জিনিস নেই যার দাম বাড়েনি। শুধু দাম বাড়েনি আমার ছেলের শেয়ারগুলোর।
রংপুরের রিকশাচালক মোজাম্মেল হক। ঢাকায় এসেছেন প্রায় ৬ বছর। বললেন এখন মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা কামাই করেও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি বলেন, মাত্র ৫ বছর আগেও খিলগাঁও রেলগেট থেকে মৌচাক যেতেন ৮ টাকা বা ১০ টাকায়। এখন নেন ২৫ টাকা। আগে মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করে ঢাকায় মেসের ভাড়া, খাওয়া খরচ, চা সিগারেটের খরচ মিটিয়ে আড়াই হাজার টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারতেন। কিন্তু এখন ১০ হাজার টাকা কামাই করেও আড়াই-তিন হাজার টাকা পাঠানো সম্ভব হয় না। প্রতিদিনকার খরচের বিবরণ তুলে ধরে মোজাম্মেল জানান, মান্ডার একটি গ্যারেজের রিকশা তিনি চালান। রিকশার জমা রোজ ১০০ টাকা। রোজ হিসেবেই মেসে থাকেন। রাতের খাওয়াসহ মেস ভাড়া রোজ ৮০ টাকা। রাস্তায় রিকশা নিয়ে বেরুলে দুপুরের খাবার ও সকালের নাস্তা, চা সিগারেটসহ খরচ আরও ১০০ টাকা। সব মিলিয়ে ৩০০ টাকা তার দৈনিক খরচ। ফলে এখন মাসে হাজার তিনেক টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারেন। ওই টাকা দিয়ে বাড়িতে তিন সন্তান, মা ও স্ত্রীর খাওয়াসহ যাবতীয় ব্যয় বহনে হিমশিম খাচ্ছেন। মোজাম্মেল বলেন, স্যার হুনছি চাইলের কেজি ১০০ ট্যাকা হবি, তাইলে মোরা বাঁচমো কেমনে।
খিলগাঁও বাজারে মিনতির কাজ করে সাইফুল, কামাল, তিনি রাশেদসহ বেশ কয়েকজন। বাজারে ঢুকলেই বড় ঝুড়ি মাথায় নিয়ে পিছে পিছে ঘুরে বলে স্যার ‘মিনতি নিবেননি, মিনতি লাগবোনি’। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারেই মিনতিদের দেখা মেলে। শাক-সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় এই মিনতিরা পড়েছেন মহাবিপাকে। মানুষ সবজি কেনা কমিয়ে দেয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়ছেন তারা। খিলগাঁও বাজারের মিনতি সাইফুল বলেন, আগে দিনে এক হাজার টাকা পর্যন্ত কামাই করেছেন। কিন্তু এখন সারা দিনে ২০০ টাকাও আয় করা যাচ্ছে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে অমানবিক জীবনযাপন করতে হচ্ছে।’ আরেক মিনতি রাশে বলেন, শাক-সবজি ও মাছের দাম বাড়ায় মানুষ যে কেনাকাটা করে তাদের ব্যাগই ভরে না। লোকজন হাতে করেই ব্যাগ নিয়ে বাসায় চলে যাচ্ছে। মিনতি প্রয়োজন হয় না। কেবল মহল্লার কিছু সবজি ব্যবসায়ী ও হোটেল মালিকরা মিনতি নেন। কিন্তু তারা আবার পারিশ্রমিক দেয় খুবই কম। এতে সামান্য কিছু রোজগার হয়। যার ফলে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে না। কারওয়ান বাজারের মিনতিদের ঝুড়ির মালিক বললেন, দিনে ১০ টাকা ভাড়ায় ঝুড়ি নেয় মিনতিরা। এক ঝুড়ি ভাড়া দেয়া রফিকুল ইসলাম বলেন, ২০০ ঝুড়ির মধ্যে এখন তিনি ভাড়া দিতে পারেন মাত্র ৮০টি। বাকিগুলো পড়েই থাকে।
নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান বলেন, জিনিসপত্রের দাম যে বাড়ছে তা মানুষের কাছে বোঝাস্বরূপ। শুধু সীমিত আয়ের মানুষই নয় সব শ্রেণীপেশার মানুষ এখন কষ্টে দিন পার করছে। সরকার নির্বাচনের আগে জিনিসপত্রের দাম কম রাখার যে অঙ্গীকার করেছিল এখন তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ভোগ্যপণ্যের দাম কমানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, দ্রব্যমূল্য বাড়লে সীমিত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা খুবই করুণ হবে এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান সরকারের পক্ষে তো নয়ই পরে বিএনপি বা অন্য কোনো সরকারের পক্ষেও এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজসাধ্য হবে না। সামষ্টিক অর্থনীতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। বৈদেশিক সাহায্য কমে গেছে। সরকার ঋণ নিয়ে দেশ চালাচ্ছে। সরকারের ঋণ দিতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা ছাপিয়ে সরকারের চাহিদা পূরণ করছে। এতে প্রতিনিয়ত মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সরকার বেশিদামে জ্বালানি এনে কম দামে বিক্রি করছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলো থেকে বেশি দামে বিদ্যুত্ কিনে কম দামে বিক্রি করছে। যাতে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে। কৃষি ও খাদ্যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সরকারের আয় কম ব্যয় অনেক বেশি। নতুন টাকার সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি হবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আর সীমিত ও নির্ধারিত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কাগুজে মুদ্রা ছেপে সাময়িকভাবে সঙ্কট সামাল দেয়া হলেও মূল্যস্ফীতির ওপর এর প্রভাব ভয়াবহ। কেনা ব্যবসায়ীরা যদি মনে করেন, এরকম মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে তাহলে তারা পণ্যমূল্যের সঙ্গে তাদের দৃষ্টিতে সম্ভাব্য মূল্যস্ফীতির হারটি ধরে নিয়ে দাম হাঁকবেন। এর ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বেসামাল হয়ে পড়বে। সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়বে। বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভয়াবহ ভঙ্গুর মধ্যে পড়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তার কাজের সমালোচনা হলে বা সরকারের কোনো পদক্ষেপের সমালোচনা করলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে রূঢ় স্বরে বলেন, রাবিশ। এখন প্রশ্ন তার ওপর ন্যস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে তিনি কী বলবেন?
বাংলাদেশ কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন ক্যাব সভাপতি কাজী ফারুক বলেন, ‘বাসাভাড়া, গাড়িভাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মানুষ দৈনন্দিনের ব্যয় কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু এখন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তারা আর ব্যয় কমানোর কোনো খাত খুঁজে পাচ্ছে না। ধারদেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে। এ অবস্থা বেশিদিন চললে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে। সরকারের উচিত সবার আগে দ্রব্যমূল্য ও জীবন যাত্রার ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেয়া।

উন্নয়ন কাজের নামে লুটপাট









কাদের গনি চৌধুরী
উন্নয়ন কাজের নামে চলছে ব্যাপক লুটপাট। টেন্ডারের ৬০ ভাগ টাকা চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেট ও ঠিকাদারদের পকেটে। বাকি ৪০ ভাগ টাকার কাজ হচ্ছে দেশে। ফলে কাজের কোনো মানই বজায় থাকছে না। সবচেয়ে বেশি অর্থ লোপাট হচ্ছে সড়ক, ব্রিজ নির্মাণ ও সংস্কার, নদী খনন, বাঁধ নির্মাণ এবং বিভিন্ন মেরামত কাজে। কাজ না করেও নদী খনন, বাঁধ নির্মাণের নামে পুরো টাকা তুলে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা রাজস্ব কোষাগারে জমা বা দাতাগোষ্ঠীকে ফেরত না দিয়ে আত্মসাত্ করা হচ্ছে। এ ধরনের বেশ কিছু অনিয়ম তদন্ত করছে দুদক।
সড়ক ও এলজিইডিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি কাজের সব টেন্ডারই বাগিয়ে নিচ্ছে সরকারি দল। তাই প্রকৃত ঠিকাদাররা কোনো কাজই পাচ্ছেন না। অধিকাংশ ঠিকাদার বেকার হয়ে পড়েছেন। এদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে ১০% কমিশনে কাজ কিনে নিয়ে কোনোমতে পেশায় টিকে আছেন।
এলজিইডির ঠিকাদাররা জানান, কাজের অর্ধেক টাকা তাদের ব্যয় করতে হয় মন্ত্রণালয়, সরকারি দল, চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারের পেছনে। ফলে কাজের মান তারা বজায় রাখতে পারছেন না। এর ফলে যে রাস্তা পাঁচ বছর পর সংস্কার করার কথা সেটি এক বছরেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। একাধিক ঠিকাদার ও এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলজিইডির বিভিন্ন পর্যায়ে কাজের সাড়ে ১৩ পার্সেন্ট, সরকারি দল থেকে কাজ কিনে নিতে দশ পার্সেন্ট, প্রকল্প পরিচালক, কনসালটেম্লট, ল্যাবরেটরি, লোকাল চাঁদাবাজদের ম্যানেজ করতে ১০ পার্সেন্ট, ঠিকাদারের লাভ ১৫ পার্সেন্ট এবং মন্ত্রণালয়কে ১০ পার্সেন্ট ঘুষ দিতে হয়। ঠিকাদাররা জানান, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীকে তিন পার্সেন্ট, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী দুই পার্সেন্ট, উপজেলা প্রকৌশলীকে সাড়ে তিন পার্সেন্ট, সহকারী প্রকৌশলী (সিনিয়র) এক পার্সেন্ট, জুনিয়র এক পার্সেন্ট, উপ-সহকারী প্রকৌশলী হাফ পার্সেন্ট, কাজের কনসালটেম্লট গ্রুপ এক পার্সেন্ট, হিসাব বিভাগ এক পার্সেন্ট, ট্রেজারি বিভাগ হাফ পার্সেন্ট এবং গুণগত মান সার্টিফিকেটের জন্য ল্যাবরেটরিকে দিতে হয় আরও হাফ পার্সেন্ট। এলজিইডির সাড়ে ১৩ পার্সেন্ট ভাগবাটোয়ার ঘটনা ওপেন সিক্রেট। এটা নিয়ে দরকষাকষির প্রয়োজন পড়ে না। আপনা আপনিই নিজ নিজ ডেস্কে এ টাকা চলে যায়।
সড়ক বিভাগের কাজে মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করতে ১০ থেকে ২০ পার্সেন্ট পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। অন্যান্য জায়গায় দিতে হয় আরও ২০ থেকে ২৫ পার্সেন্ট ঘুষ। এটাও ওপেন সিক্রেট। এর জন্যও দরকষাকষির প্রয়োজন পড়ে না। কোথায় কত টাকা দিতে হবে টেন্ডার পাওয়ার আগেই বলে দেয়া থাকে। সরকারি দলের ঠিকাদার থেকে কাজ কিনে নেয়া এবং ঠিকাদারের লভ্যাংশ বাদ দিলে ৪০ পার্সেন্টের বেশি টাকার কাজ হয় না বলে সড়ক ও যোগাযোগ বিভাগের একটি সূত্র জানায়।
ওয়াসার কাজে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় বলে জানান ঠিকাদাররা। ওয়াসার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিতে হয় কাজের ২০ পার্সেন্ট। এদের মধ্যে ভাগ পান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ-বিভাগীয় সহকারী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর দফতর। এমডির জন্য ভাগ থাকলেও বর্তমান এমডি ঘুষ খান না
বলে একাধিক ঠিকাদার জানান। এছাড়া কাজ ক্রয়, ঠিকাদারের লাভ এবং অন্যান্য খাতে চলে যায় ৪০ পার্সেন্ট টাকা। বিশেষ করে অগ্রিম আয়কর হিসেবে সাড়ে আট পার্সেন্ট টাকা শুরুতেই কেটে রাখা হয়। নিরাপত্তা জামানত হিসেবে এক বছরের জন্য জমা রাখা হয় আরও ১০ পার্সেন্ট। ওয়াসার একটি সূত্র জানায়, গত আড়াই বছর ধরে যত টেন্ডার হয়েছে এর সবই পেয়েছেন সরকারি দলের নেতা ও সরকার সমর্থক ঠিকাদাররা। ফলে পেশাদার ঠিকাদারদের থাকতে হয়েছে বেকার । অনেকে সরকারি দলের নেতাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে কাজ করছেন।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর, পিডব্লিউডি, রাজউক, সিটি করপোরেশন, বিআইডব্লিউটিএ, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সব জায়গায় একই অবস্থা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদার জানান, তিনি এলজিইডির প্রায় এক কোটি টাকার একটি কাজ কিনে নেন ১৫ লাখ টাকায়। এছাড়াও তাকে এলজিইডিসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আরও ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। তিনি জানান, এখনও কনসালটেম্লট গ্রুপ, হিসাব বিভাগ, ট্রেজারি বিভাগ এবং গুণগত মান সার্টিফিকেটের জন্য ল্যাবরেটরিকে তাদের পার্সেন্টেস দেয়া হয়নি। ক্ষোভের সঙ্গে ওই ঠিকাদার জানান, এখন যদি ৭০ ভাগ কাজ করি তাহলে বাবার জমি বিক্রি করে এনে সরকারি কাজ করতে হবে। সড়কের এক প্রকৌশলী জানান, মন্ত্রণালয় ও সওজ কর্মকর্তাদের দাবি মতো টাকা দিতে না পারায় তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ এনে ওয়ার্ক অর্ডার বাতিলের চেষ্টা করলে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন।
প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা আত্মসাত্ : সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডির অধিকাংশ প্রকল্পের অব্যয়িত টাকা রাজস্বখাতে জমা না দিয়ে আত্মসাত্ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এলজিইডির আরডিপি-২১ প্রকল্প ক্লোজিংয়ের সময় প্রায় ১০ কোটি টাকা অব্যয়িত থেকে যায়। এ টাকা রাজস্বখাতে জমা না দিয়ে তত্কালীন পিডি প্রকল্পের অননুমোদিত পূবালী ব্যাংক, ফার্মগেট, ঢাকা’র এসটিডি-৩৪ নম্বর হিসাবের মাধ্যমে আত্মসাত্ করা হয়। বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত ও পল্লী উন্নয়ন পুনর্বাসন প্রকল্প ২০০৪-এও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ প্রকল্পের অব্যয়িত প্রায় ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের উদ্দেশ্যে সরিয়ে ফেলা হয়। এ ব্যাপারে দুদকে মামলা হলে দ্রুত তা জমা দিয়ে দেয়া হয়। একইভাবে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প আরডিপি-১৩, ১৮ ও ২৫ প্রকল্পের অব্যয়িত টাকাও আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, সিএইচটি আইডিপি প্রকল্পের আওতায় রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়কের আসাম বস্তিসংলগ্ন ৯৬ মিটার দীর্ঘ ব্রিজের অ্যাপ্রোচ রোড না করে প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ ব্যয় করার লক্ষ্যে শুকনো স্থানে আরও একটি ২০৪ মিটার দীর্ঘ ব্রিজ তৈরি করে প্রায় ২ কোটি টাকা সিএইচটি আইডিপি প্রকল্পের পরিচালকের সহায়তায় লুটপাট করা হয়।
কাজ না করে ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বিল প্রদানের ঘটনাও ঘটেছে এখানে। এলজিইডির একটি সূত্র জানায়, বরগুনা জেলার পাথরঘাটা, কাকচিরা, বামনা, রাজাপুর, কাটালিয়া সড়কটি সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন হলেও ২০০৭ সালে এটি সংস্কার করে এলজিইডি। নামসর্বস্ব পত্রিকায় গোপনে বিজ্ঞাপন দিয়ে টেন্ডারের মাধ্যমে বরাদ্দ ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকার সমুদয় বিল প্রদান করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। ঠিকাদার ঘুষ দিয়ে সামান্য কাজ করে পুরো টাকা উঠিয়ে নেয়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সূত্রে জানা যায়, এলজিইডিতে বছরে প্রায় ৬২৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। এলজিইডির অভ্যন্তরীণ তদন্তে দুর্নীতির গড় অনুমিত হিসাব ১০৩ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগে বিগত দু’বছরে প্রধান প্রকৌশলীর দফতরে জমা পড়া অভিযোগ, অভিযোগের তদন্ত এবং দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হওয়া টাকার অঙ্কের গড় হিসাবে দুর্নীতির এ চিত্র পাওয়া গেছে। গত তিন বছরে ১২৭ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে এলজিইডিতে। এর মধ্যে ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
এলজিইডির একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই শত ভাগ কাজ দেখিয়ে বিল তুলে নেয়া, সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত স্থাপনা নির্মাণ, কর্মকর্তাদের স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে অবৈধভাবে ওইসব প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ বরাদ্দ দেয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণের টাকা অপচয় করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, এলজিইডিতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় গ্রামাঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ ও সড়ক সংস্কার প্রকল্পে। বছরে সড়ক সংস্কারের জন্য সহস্রাধিক ছোট ছোট প্রকল্প হাতে নেয়ার মতো দুর্নীতি হচ্ছে এখানে। এসব প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রথমেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘুষের কারণে এসব প্রকল্পের ব্যয় শুরু থেকেই বেশি ধরা হয়। কোনো সড়ক উন্নয়নে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হলেও তা দেখানো হয় ৭ কোটি টাকা। প্রকল্প অনুমোদনের পর টেন্ডার প্রক্রিয়ার জালিয়াতি ওপেন সিক্রেট। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি, মন্ত্রী ও সচিব প্রভাববিস্তার করেন বলে অভিযোগ আছে। সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী সুযোগ বুঝে আগেই সমঝোতা করে নেন স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে। আর এ সমঝোতার ফল হিসাবে বেশিরভাগ প্রকল্প শত ভাগ বাস্তবায়ন না করেই বিল তুলে নেয়া হয়। বছরের পর বছর একই সড়ক নতুন প্রকল্প হিসাবে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে টেন্ডার জালিয়াতি এবং ভুয়া বিলের অভিযোগই বেশি পাওয়া যায়।
এলজিইডিতে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এখানে তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সিন্ডিকেটকে ম্যানেজ না করলে কাজ পাওয়া যায় না বলে সূত্র জানায়। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেছে বলে জানা গেছে। দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজ হিসাবে এই প্রধান প্রকৌশলীর সম্পত্তির হিসাব চেয়ে নোটিশ দেয়া হয়। দুদক তদন্ত করে জানতে পারে, প্রধান প্রকৌশলী তার স্ত্রী সুফিয়া খাতুনের নামে দেড় বিঘা জমির ওপর বাড়ি নির্মাণ করেছেন। ৬ ইউনিটের এই বাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য ১৫ কোটি টাকা। তাছাড়া গাজীপুরে বাগানবাড়ি, কুমিল্লায় দেড়শ’ বিঘা জমি, কাঁচপুরে জমি এবং ৫টি ব্যাংকে স্ত্রী সুফিয়া খাতুন ও মেয়ে বদরুন্নাহার দীনার নামে ১৯ লাখ টাকার এফডিআর রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিভাগের এলজিইডির সহকারী প্রকৌশলী মো. আতিয়ার রহমান, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও ঢাকা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী খুরশীদ আলমকে নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যারা এলজিইডিকে লুটপাট করে খাচ্ছে।

Thursday, 22 September 2011

জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের বিবৃতি : আবুল আসাদকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকি

স্টাফ রিপোর্টার
দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক ও প্রবীণ সাংবাদিক আবুল আসাদকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়ায় তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠন। পৃথক বিবৃতিতে নেতারা বলেন, সম্পূর্ণ অন্যায় ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আবুল আসাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন স্বনামধন্য সম্পাদককে গ্রেফতারের ঘটনা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি হুমকিস্বরূপ। গণতান্ত্রিক সমাজে কোনোভাবেই এটা কাম্য হতে পারে না। তারা অবিলম্বে আবুল আসাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি সরকার তার নিজস্ব প্রণীত আইন লঙ্ঘন করে সাংবাদিকদের ওপর হয়রানিমূলক আচরণ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ২০ সেপ্টেম্বর দেশের প্রবীণ সাংবাদিক এবং দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু গ্রেফতার করেই সরকার ক্ষান্ত হয়নি, তাকে নেয়া হয়েছে রিমান্ডে। এটা সাংবাদিক সমাজকে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
উল্লেখ্য, এর আগে দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দীর্ঘকাল আটকে রেখে রিমান্ডে নির্যাতন করা হয়। এসব অনভিপ্রেত ঘটনা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিকাশ, মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অন্তরায়। যেখানে সরকারের সাংবাদিকতা পেশায় পৃষ্ঠপোষকতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রদানের কথা—সেখানে প্রবীণ স্বনামধন্য একজন সম্পাদককে এভাবে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নির্যাতন চালানোর ঘটনায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি হুমকির নামান্তর। গণতান্ত্রিক সমাজে এ অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সরকার সাংবাদিকদের ওপর এ ধরনের হয়রানি ও নিবর্তনমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকবে বলে তারা প্রত্যাশা ও দাবি করেন এবং অবিলম্বে তার মুক্তির দাবি জানান।
সম্মিলিত পেশাজীবী ফোরাম সভাপতি অধ্যাপক ড. চৌধুরী মাহমুদুল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শেখ আল আমিন এক বিবৃতিতে বলেন, সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ গ্রেফতার করা হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের সৃষ্ট দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি, দুর্নীতি, অনিয়ম, শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারি, দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতা, ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি, বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়নে জনজীবনে দুর্গতির বিষয়ে দেশের সাংবাদিকরা যখন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করছে, ঠিক তখনই সরকার সাংবাদিকদের স্তব্ধ করতে গ্রেফতার ও নির্যাতন শুরু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বরেণ্য সাংবাদিক দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকারের এ দমন-পীড়নের প্রতিবাদ জানানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে পেশাজীবীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
তারা বলেন, সাংবাদিকসহ পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, বিরোধী দল যাতে সরকারের অন্যায়, নির্যাতন ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে না পারে, সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে এর আগেও পুলিশ দিয়ে মামলা-হামলা, রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা হয়েছে। সরকারের এই ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডে সরকার সমর্থক কিছু মানবাধিকার নেতা ও সাংবাদিক সমর্থন জুগিয়ে বানোয়াট রিপোর্ট পেশ করে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। এই দলটি যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই পেশাজীবীদের পেশাভিত্তিক কর্মকাণ্ড চালাতে বিশেষ করে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন নেমে এসেছে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশবরেণ্য সম্পাদক আবুল আসাদকে গ্রেফতার করে বানোয়াট মামলায় রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এ অবস্থায় পেশাজীবীদের বসে থাকলে চলবে না, সর্বস্তরের জনগণের মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তারা বয়োবৃদ্ধ সাংবাদিক আবুল আসাদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে দ্রুত মুক্তির জোর দাবি জানান।
দৈনিক সংগ্রাম এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের প্রতিবাদ সভায় অবিলম্বে সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের মুক্তি দাবি করা হয়। এবিএম হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন মো. এনামুল হক, খন্দকার এমদাদুল হক, সেক্রেটারি কামরুল আহসান, আনোয়ার হোসেন, হাবিবুল্লাহ হাবীব, হাবিবুর রহমান খান ও গোলাপ হোসেন।

Friday, 5 August 2011

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ



ডেস্ক রিপোর্ট
শুরু হয়েছে মাহে রমজান। সিয়াম সাধনার জন্য মুসলমানরা এ মাসের অপেক্ষায় ছিলেন। আর নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা যেন অপেক্ষায় ছিলেন অধিক মুনাফা লাভের আশায়। চলতি রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বিস্তারিত খবর আমাদের প্রতিনিধিদের :
মংলা (বাগেরহাট) : মংলার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বাজারে উপস্থিত ক্রেতা সাহাবুদ্দিন, মামুন, রনি, নাজমা, ইদ্রিস অভিযোগ করে বলেন, রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলেছে। এব্যাপারে তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন। ব্যবসায়ীরা জানান, রমজান সামনে রেখে প্রতি বছরই মহাজনরা পণ্য মজুত রেখে দাম বাড়িয়ে দেন। ফলে তাদের কিছু করার থাকে না। মংলা বণিক সমিতির সভাপতি হাবিব মাস্টার বলেন, রমজান উপলক্ষে কোনোভাবেই যেন দাম না বাড়ে সে জন্য সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ব্যবসায়ীদের ওপর কড়া দৃষ্টি রাখছে।
রাঙ্গুুনিয়া (চট্টগ্রাম) : রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। রমজান মাস শুরুতে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। চাল, ডাল, তেল, মরিচ ও শাকসবজিসহ অনেক পণ্যের দাম দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন হাটবাজার পরিদর্শন করে জানা যায়, উপজেলার রোয়াজারহাট, রানীরহাট, দোভাষী বাজার, কোদালা বাজার, শিলক, পদুয়া রাজারহাট, ধামাইরহাট, শান্তিরহাট, গোছরাবাজারসহ অধিকাংশ হাটবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এসব বাজারে কাঁচামাল ব্যবসায়ীদের একাধিক সমিতি রয়েছে। যারা বাজার পরিস্থিতি বুঝে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় বলে জানা গেছে। ফলে হাটবাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চট্টগ্রাম শহরের চেয়ে অনেক বেশি দামে ক্রয় করতে হয়। রমজান মাস শুরুতে বাজারগুলোতে অনেক পণ্যের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা দাবি করছেন।
হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) : হাটহাজারীতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলছে। বাজার মনিটরিংয়ের একটি কমিটি থাকার পরও ওই কমিটি দায়িত্ব পালন না করায় এ অবস্থা হয়েছে হাটহাজারীতে। এদিকে প্রতিদিন কাঁচাবাজার, মাছ, মাংস, মুরগি ও সবজিসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বেশি দামে ক্রয় করেও প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা ওজনে প্রতি কেজিতে ১০০ গ্রাম করে কম দিচ্ছে বলে ক্রেতারা জানান। বর্তমানে বাজারে ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও অনেক দোকানে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। আর প্রতিদিন বেড়েই চলছে চিনির দাম।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে জানা যায়, গত কয়েক বছরের বাজার দর হার মেনেছে এবার। হাটহাজারীর বিভিন্ন বাজারে চিনি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা, সয়াবিন তেল ১১০-১২০ টাকা, ছোলা ৮০-৮৫ টাকা, পেঁয়াজ ২৮-৩০ টাকা, বেগুন ৪০-৪৫ টাকা, ধনেপাতা দেশি ৩০০ টাকা, শসা/ফল ৪০-৪৫ টাকা, মরিচ ৯০-১০০ টাকা, বরবটি ৫০-৬০ টাকা, মুরগি ১৪০-১৪৫ টাকা, মাংস (হাড়ছাড়া) ৩৫০ টাকা, (হাড়সহ) ৩০০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। সাধারণ ক্রেতারা এসব বাজারে বেশি দামে ক্রয় করে প্রতিদিন হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সাপাহার (নওগাঁ) : শুরু হয়েছে মাহে রমজান। সিয়াম সাধনার জন্য মুসলমানরা এ মাসের অপেক্ষায় ছিলেন। আর নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা যেন অপেক্ষায় ছিলেন অধিক মুনাফা লাভের আশায়। তাই রোজা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাজারগুলোতে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার হিড়িক পড়েছে। রোজার প্রথম দিনে উপজেলার বাজারগুলোতে ক্রেতার ঢল নেমেছিল। আর এ সুযোগে আরেক দফয় সব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে বিক্রেতারা। বিভিন্ন হাটবাজারে, চাল, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজণীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। ফলে রমজান মাসে বাজার করতে এসে জিনিসপত্রের দাম শুনে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। ত্বরিত্ গতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না হলে চলতি পবিত্র রমজান মাসে ক্রেতাসাধারণ চরম ভোগান্তির শিকার হবে। হাটবাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর আমদানির অভাব না থাকলেও হঠাত্ করে চাল, আটা, সয়াবিন, রসুন, আদা, চিনি ও গুড়সহ প্রায় সব জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে যে চাল, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যে দরে বিক্রি হয়েছে বর্তমানে সেসব দ্রব্যের মূল্য প্রতি কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে।
সালথা (ফরিদপুর) : ফরিদপুরের নগরকান্দা ও সালথা উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন হাটবাজারে গত এক সপ্তাহে চিনি, পেঁয়াজ, ছোলা, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকদফা। বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবখানেই নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বুধবার উপজেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চিনি প্রতি কেজি ৭৫-৮০, সয়াবিন ১৩০-১৩৫, আটা ৩৫-৪০, মসুর ডাল ৯০-১০০, খেসারির ডাল ৫৫-৬০, ছোলা ৭৫-৮০, পোলট্র্রি মুরগি ১৫০-১৬০, গরুর গোশত ২৮০-৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি বেড়েছে তরিতরকারি ও বিভিন্ন ধরনের ফলমূলের দাম। আলু প্রতি কেজি ১৫-১৮, বেগুন ৩০-৪০, পেঁয়াজ ৩০-৩৫,পটল ৩২-৩৬, পেঁপে ১৮-২০, খেজুর ৮০-২৫০, আপেল ১৪০-১৬০ টাকা। দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন দিনমজুর ও সমাজের নিম্নআয়ের মানুষ। বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার না থাকায় এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বি হয়েছে বলে ক্রেতারা মনে করছেন। ক্রেতারা আরও জানান আগে কয়েকদিন পরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাতে বাজারের জিনিসপত্রের দাম ও পণ্যের গুণগতমান ঠিক ছিল। কিন্তু গত বছর সহকারী কমিশনার ভূমি কার্বাইড মিশ্রিত আম ধরার কয়েকদিন পর তাকে অন্যত্র বদলি করানোর পর থেকে এ পর্যন্ত আর কোনো ভ্রাম্যমাণ আদালত বাজার মনিটরিং করেননি। ফলে ব্যবসায়ীরা লাগামহীনভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে।
তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) : রমজানের প্রথম দিন থেকে কাঁচাবাজার তথা শাক-সবজি, মাছ-মাংসের দোকানে যেন আগুন লেগেছে। আর এসব দ্রব্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। গত ১ সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। বাজার তদারকি কর্মকর্তা না থাকায় একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মনগড়া মূল্য নির্ধারণ করে এসব দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করছে। সরকারিভাবে প্রতিলিটার সয়াবিন তেল ১০৫ টাকা বিক্রি করার কথা থাকলেও তাহিরপুরে প্রতি কেজি সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকায় । চিনির দাম প্রতিকেজি ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। ১০ টাকা কেজির আলু বিক্রি হচ্ছে ১৬ টাকায়। কাঁচামরিচ ৪০ টাকা থেকে বেড়ে দ্বিগুণ ৮০ টাকায়। নিম্নমানের খেজুর ৭০ টাকা, আশ্বিনা আম ৮০ থেকে ১২০ টাকা, আদা ৫০ থেকে ৮০, শসা ২০ থেকে ৪০, চাল প্রতি ৫০ কেজি বস্তা মোটা ও চিকন চাল প্রতি বস্তায় বেড়েছে ১শ’ থেকে ১৫০ টাকা। এছাড়া আরও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক। ফলে নিম্নআয়ের মানুষ এসব দ্রব্য কিনতে গিয়ে পড়ছে চরম বিপাকে।
নাগরপুর (টাঙ্গাইল) : বাজার মনিটরিং না থাকায় নাগরপুরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। উপজেলার সদর বাজারসহ আশপাশের বাজারগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য একেক দোকানে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না ব্যবসায়ীরা। এতে ক্রেতা সাধারণ প্রতারিত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের কোনো মাথা ব্যথা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার উপজেলার সদর বাজারের বিভিন্ন দোকান ঘুরে নিয়ন্ত্রণহীন বাজারের বিভিন্ন অসঙ্গতি চোখে পড়ে। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে তাদের ইচ্ছেমত পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। জানা যায়, গত একদিনের ব্যবধানে কাঁচামরিচ ৬০ টাকার পরিবর্তে ৮০ টাকা, ছোলা ৬৫-৭০, চিনি ৬৬-৭০ ও খোলা সয়াবিন লিটার প্রতি ১০৫ টাকা থেকে ১১০, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১১৫ টাকাও বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতা তোফায়েল জানান, সরকার কর্তৃক দাম নির্ধারণ করা থাকলেও শুধু মনিটরিংয়ের অভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে বাজার। ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী সুধির মণ্ডল বলেন, একদিন আগে কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে ৫০/৬০ টাকা দরে। একদিনের ব্যবধানে বৃহস্পতিবার ২০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতা হাসমত আলী, নজরুল ও কাইয়ুম জানান, খুচরা দোকানিরা খোলা সয়াবিন ১১০ থেকে ১১৫ টাকা বিক্রি করছে। এছাড়া পিঁয়াজ, রসুন, আদাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দামও আকাশচুম্বী