Wednesday 23 February 2011

ডকুমেন্ট বলছে ভিন্নকথা : ১০ টাকা কেজি চালের কথা ’৯৬ সালে বলেছি, এবার নয় - সংসদে শেখ হাসিনা


সংসদ রিপোর্টার

বিরোধী দল মিথ্যাচার ও অপপ্রচারে পারদর্শী অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী জনসভার বক্তৃতাকে তারা (বিএনপি) ২০০৮ সালের বলে চালিয়ে দিয়েছে। ’৯৬ সালের নির্বাচনী বক্তৃতার সঙ্গে তারা ২০০৮ সালের ক্যাপশন লিখে ইউ-টিউবে ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রচার করছে নির্বাচনের আগে আমি নাকি বক্তৃতা দিয়েছিলাম ক্ষমতায় আসতে পারলে ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আমরা দশ টাকা কেজি চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে তা রক্ষা করেছি। এবার আমরা জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার কথা বলেছি এবং ক্ষমতায় এসে ৪৫ টাকার চাল ১৮/২০ টাকায় নামিয়ে আনি। পরে কৃষকদের ন্যায্যমূল্যের কথা চিন্তা করে কিছুটা বাড়িয়েছি। তিনি বিরোধী দলের প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা ১০ টাকায় যে চাল রেখে এলাম সেটা কেন ৪৫ টাকা হলো? কেন ৫ টাকা কেজি করতে পারলেন না তার জবাব দিন।
গতকাল জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরপর্বে ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক জাসদ দলীয় সংসদ সদস্য মঈনুদ্দিন খান বাদলের সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। স্পিকার আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেটের সভাপতিত্বে গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টায় সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনের প্রথম আধঘণ্টা প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত প্রশ্নোত্তরপর্ব চলে।
এদিকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ’৯৬ সালে নয়, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই শেখ হাসিনা বিভিন্ন নির্বাচনী সমাবেশে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির প্রথম দফা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন নির্বাচনী সভায় শেখ হাসিনা ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতির কথা বহুবার বলেছেন। জরুরি সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে নির্বাচন ২ বছর পেছালেও ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানো নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত ছিল। যদিও নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সরাসরি ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর বিষয়টি উল্লেখ করেনি। ১৮ টাকা কেজির কথাও বলা হয়নি। তবে বিভিন্ন জনসভা, লিফলেট ও মিছিলের স্লোগানে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানো নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সোচ্চার ছিলেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল বলে প্রধানন্ত্রীর বক্তব্যের সত্যতাও মেলেনি।
সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির দেয়া তথ্য মতে, ’৯৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি প্রথম দফায় ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার বছরে মোটা চালের সর্বনিম্ন দর ১০ টাকা আর সর্বোচ্চ ১৫ টাকা ছিল। ’৯৭-তে সর্বনিম্ন দর ঠিক থাকলেও সর্বোচ্চ দর ২৪ টাকায় পৌঁছেছিল। টিসিবি বলছে, ২০০১ সালেও মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ১৪ টাকা কেজিতে। বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার সময় ২০০৬ সালে সর্বনিম্ন দর ছিল ১৭ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১৯ টাকা। ২০০৮ সালে জরুরি সরকারের সময় মোটা চালের সর্বনিম্ন দর ছিল ২৮ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা।
১০ টাকা কেজির চাল নিয়ে গতকাল সংসদে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী : গতকাল সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরপর্বে ‘সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কীভাবে বিরোধীদলীয় নেতার হৃদয়ঙ্গম হয় সে বিষয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ রয়েছে কিনা’ মঈনুদ্দিন খান বাদলের এ সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হৃদয়ঙ্গম করার বিষয়ে আমি এত পারদর্শী নই। মাননীয় সংসদ সদস্যই (বাদল) এ বিষয়ে পারদর্শী। তাই হৃদয়ঙ্গম করার দায়িত্বটা তাকেই দিলাম। তিনি চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এ সময়ে বিরোধী দলের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য তারা ক্ষমতায় আসেনি। তারা নিজেদের ভোগবিলাসে ব্যস্ত ছিল। তারা জনগণের সমস্যাগুলো আমলে নেয়নি। তাদের দুঃখ হলো—আমরা মেগাপ্রজেক্ট করছি। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করছি। মানুষের উপকারের জন্য কাজ করছি। তা তাদের পছন্দ হচ্ছে না।
বিরোধী দল ইন্টারনেটে তার বক্তৃতার ফুটেজ বিকৃত করে অপপ্রচার চালাচ্ছে অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা মিথ্যাচার ও অপপ্রচারে পারদর্শী। নির্বাচনের আগে আমি নাকি বক্তৃতা দিয়েছিলাম ক্ষমতায় আসতে পারলে ১০টাকা কেজি চাল খাওয়াবো। এটা ওয়েবসাইটের ইউটিউবে ছেড়ে দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। এটা ঠিক, আমরা ১৯৯৬ সালে ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং তা রেখেছিও। আমরা ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার আগ পর্যন্ত তা ছিল। সেই চাল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বৃদ্ধি পেতে পেতে মানুষকে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকায় কিনতে হয়েছে।
ইউটিউবের ফুটেজ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমি ওই বক্তৃতা বার বার দেখেছি। আমি কোথায় কী বক্তৃতা দিয়েছি, ওই সময় কে কে ছিলো, আমার দলের প্রার্থী কে ছিলো সেটা দেখেছি। ইউটিউবের ফুটেজটা কয়েকবার খুব ভালোভাবে দেখলাম। এটা হচ্ছে আমার ’৯৬ সালের নির্বাচনী বক্তৃতা। ১৯৯৬ সালে আমি তেজগাঁওয়ের একটি জনসভায় ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর কথা বলেছিলাম। ওই বক্তৃতার সঙ্গে তারা ২০০৮ সালের ক্যাপশন লিখে চালিয়ে দিয়েছে। আমরা তো দশ টাকায় চাল রেখে এলাম, সেটা কেন ৪৫ টাকা হলো? কেন ৫ টাকা কেজি করতে পারলেন না তার জবাব দিন। একবার বাড়লে তো কোন জিনিসের দাম কমে না। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আমরা জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দেখেছিলাম। ২০০৯ সালে আমরা ক্ষমতায় এসে ৪৫টাকার চাল ১৮/২০ টাকায় নামিয়ে আনি। তারপর কৃষকের কথা ভেবে আবার কিছুটা বাড়িয়েছি। আমরা মানুষের আয়ও বৃদ্ধি করেছি।
’৯৬ সালে নয়, গত সংসদ নির্বাচনের আগেই ১০ টাকা কেজির চালের কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী : অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণার পর টাঙ্গাইল ও জামালপুরের জনসভায় শেখ হাসিনা ১০ টাকা কেজিতে চাল খেতে নৌকায় ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। ২০০৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় ‘টাঙ্গাইল ও জামালপুরে শেখ হাসিনা...’ শিরোনামে ডাবল কলামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী হাইস্কুলের জনসভায় তিনি ড. আবদুর রাজ্জাককে দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, জোট সরকারের দুর্নীতি ও দুঃশাসন থেকে মুক্তি এবং অর্থনৈতিক সফলতা অর্জনে নৌকায় ভোট দিন। তিনি স্লোগান দেন, নৌকা মার্কায় ভোট দেব, ১০ টাকা সের চাল খাব। ধানের শীষে ভোট দেব না ২০ টাকা সের চাল খাব না।’ একই দিনে জামালপুরের মাদারগঞ্জ বালিজুড়ী এফএম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মির্জা আজমের জন্য নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দেশকে বাঁচাতে হলে নৌকা ছাড়া উপায় নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশে ১০০ ভাগ লোককে শিক্ষিত করা হবে। দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা হবে। চালের সের ১০ টাকা হবে, দেশ আবার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।’
১৭ সেপ্টেম্বরের আমার দেশ পত্রিকার প্রথম পাতায় শিরোনাম ছিল ‘টাঙ্গাইল ও জামালপুরে শেখ হাসিনা : ২০ টাকার চাল ১০ টাকায় খেতে হলে নৌকায় ভোট দিন’। সেদিনের সবকটি জাতীয় দৈনিকে শেখ হাসিনার এ প্রতিশ্রুতির কথা প্রকাশিত হয়। টিভি চ্যানেলগুলোতেও একই খবর প্রচারিত হয়। এরপর অসংখ্য সমাবেশে শেখ হাসিনা এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ‘নৌকা মার্কায় ভোট দেব, ১০ টাকা সের চাল খাব’—শেখ হাসিনার এ স্লোগান ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে সারাদেশের অলিতে-গলিতে উচ্চারিত হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মুখে। শুধু তাই নয়, গত বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন মোটা চালের কেজি ৩৫/৪০ টাকায় গিয়ে পৌঁছায় তখন শেখ হাসিনা কারাগারে ছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনাকে আদালতে নেয়া হয়। পরদিন আমার দেশ পত্রিকার লিড স্টোরির হাইলাইটসে শেখ হাসিনার বরাতে ছাপা হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দ্রব্যমূল্য অর্ধেকে নামিয়ে আনা হবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা হবে। চালের দাম কমিয়ে ১২ থেকে ১৫ টাকায় আনা হবে।’
তবে শেখ হাসিনা মুক্ত হওয়ার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে ২৪ ডিসেম্বর বগুড়ার শেরপুর বাসস্ট্যান্ডের সমাবেশে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর কথা বলেন। তিনি নৌকা মার্কাকে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ার মার্কা বলে উল্লেখ করেন। তিনি সেখানকার প্রার্থী হাবিবুর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ১০ টাকায় চাল খেতে হলে নৌকায় ভোট দিতে হবে। দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে হলে নৌকায় ভোট দিতে হবে। ২৫ ডিসেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য জিল্লুর রহমান কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর কমিউনিটি সেন্টারে ২ ডিসেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বলেন, তার দল ক্ষমতায় গেলে প্রতি কেজি চালের দাম কমিয়ে ১০ টাকা ও কাঁচামরিচের কেজি ৫ টাকা করা হবে। ৩ ডিসেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্তসহ বিভিন্ন পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য নেতাকর্মীও একইভাবে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর প্রচারণা চালিয়েছেন।
এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়, জরুরি সরকারের হস্তক্ষেপে নির্বাচন প্রায় ২ বছর পিছিয়ে গেলেও শেখ হাসিনা এ সময় ধরে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি অব্যাহত রাখেন। জোট সরকার ক্ষমতায় থাকতে তিনি যখন এ প্রচারণা শুরু করেন তখন চালের কেজি ছিল তার বক্তব্য অনুযায়ীই ২০ টাকা। যদিও বাস্তবে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাব অনুযায়ী ২০০৬ সালে মোটা চালের কেজি ছিল সর্বনিম্ন সাড়ে ১৬ টাকা। অথচ প্রধানমন্ত্রী এটাকে ৪৫ টাকা বলেছেন। জরুরি সরকারের সময়ে মোটা চালের কেজি ৩৫ টাকা পর্যন্ত পৌঁছলেও জরুরি সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময় চালের কেজি ২২ টাকায় নেমে আসে। কিন্তু মাঝখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চালের দাম বেশি বেড়ে যাওয়ায় তিনি অর্ধেক দামে চালসহ দ্রব্যমূল্য খাওয়ানোর কথা বলেন। এ কারণে জেলে থাকতে তিনি ১২ থেকে ১৫ টাকায় চাল খাওয়ানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু আবার চালের দাম কমতে শুরু করায় তিনি ও তার দলের নেতারা নির্বাচনের আগে ১০ টাকায় চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। নির্বাচনী প্রচার ও লিফলেটেও এটা স্থান পায়।
এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তখন সবচেয়ে মোটা চাল ২২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে বলে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও টিভি চ্যানেলে খবর প্রচারিত হয়। সেক্ষেত্রে তার দুই বছর আগের ঘোষণা অনুযায়ী ২০ টাকার চাল ১০ টাকা হলে, ২২ টাকার চাল ১১ টাকা হতেই পারে। যদিও নির্বাচনী প্রচারে ১০ টাকার কথাই বলা হয়েছে।
১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি নিয়ে নির্বাচনের আগে যখন আওয়ামী লীগ ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছিল তখন প্রশ্ন ওঠে কৃষক কীভাবে পোষাবে। এত কম দামে চাল বিক্রি করতে হলে কৃষকের খরচ উঠবে না। তখনই প্রথমে শেখ হাসিনা বিভিন্ন জনসভায় ন্যায্যমূল্যে সার দেয়ার কথা বললেও একপর্যায়ে তিনি জনসভাগুলোতে বিনামূল্যে কৃষককে সার দেয়ার কথা বলতে শুরু করেন। এর প্রমাণ বিভিন্ন পত্রিকায় রয়েছে। প্রথম আলোর ১৮ ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘কোটালীপাড়ার সেই মাঠে ভোট চাইলেন হাসিনা’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠার ডাবল কলাম খবরের ভেতরে দেখা যায়, ১৭ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার নিজ নির্বাচনী এলাকার জনসভায় শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ‘...বয়স্কভাতা দ্বিগুণ করা হবে, তাদের চলাফেরা ফ্রি করে দেবে। কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে সার বিতরণ করা হবে।’
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আসলেই ১০ টাকা কেজিতে চাল ও বিনামূল্যে কৃষকদের সার দেবে, নাকি এটা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে লিখিতভাবে নেই, তাদের নেত্রী নির্বাচনী সমাবেশে বলেছেন—এসব তাদের প্রতিশ্রুতি নয় বলে এড়িয়ে যাবে?
আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা অতীতে ‘বিরোধী দলে গেলেও হরতাল করব না’ বলে সংসদ ও রাজপথে বারবার ঘোষণা দিয়েও ২০০১ সালের পর সে ঘোষণা বাস্তবায়ন না করে আওয়ামী লীগ একের পর এক হরতাল করেছে। এবারও মনে হচ্ছে ১০ টাকায় চাল ও বিনামূল্যে সার দেয়ার প্রতিশ্রুতিকে ‘বাত কা বাত’ হয়েই থাকবে।
সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তরপর্বে অন্যান্য প্রসঙ্গ : সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মোস্তাক আহমেদ রুহীর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোনো দীর্ঘসূত্রতা নেই। তবে, কিছুটা জটিলতা থাকতে পারে। কারণ বিগত চারদলীয় জোট সরকার সর্বক্ষেত্রে এমনভাবে দলীয়করণ করেছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবে, আমরা জনগণের কাছে দেয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।
বুধবার বর্তমান সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শততম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে উল্লেখ করে এ সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত কতটুকু বাস্তবায়ন হলো কতগুলো বাস্তবায়নাধীন প্রতি তিন মাস অন্তর তা পর্যালোচনা করা হয়। তাতে দেখা গেছে, আমাদের সিদ্ধান্তের ৮৪ ভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। কোন কোন মন্ত্রণালয়ে হয়েছে শতভাগ। তাই পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই, সরকারের কর্মকাণ্ডে কোন দীর্ঘসূত্রতা নেই।
প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয় রোধ করার বিষয়ে সরকার দলীয় সিনিয়র সদস্য আবদূর রাজ্জাকের সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুনেছিলাম গ্যাসের ওপর বাংলাদেশ ভাসছে। এই গ্যাস বেচতেই হবে। আমরা ক্ষমতায় থাকতে ১৯৯৬-২০০১ সালে গ্যাস বিক্রির চাপ ছিলো। গ্যাস বিক্রি করতে রাজি হইনি বলে অনেক ষড়যন্ত্র করে আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি। আর এখন দেখছি তীব্র গ্যাস সঙ্কট। আমরা গ্যাস সঙ্কট মোকাবিলার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছি। বাপেক্সকে শক্তিশালী করে নিজেরাই গ্যাস উত্তোলনের চেষ্টা করছি। গ্যাসের অপচয় রোধে বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার চালুর ব্যবস্থা নিচ্ছি। নিজেরাই সিলিন্ডার তৈরি ও এর দাম কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছি।
এদিকে এক লিখিত প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে বিদ্যুত্ খাতে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ‘জোট সরকারের আমলে বিদ্যুত্ খাতের দুর্নীতি অনিয়মের শ্বেতপত্র প্রকাশ ও দুর্নীতিবাজদের বিচারের সম্মুখীন করা হবে কিনা’ সরকার দলীয় সংসদ সদস্য চয়ন ইসলামের এ প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিগত জোট সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতে সংঘটিত আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম উদঘাটনের লক্ষ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি গঠিত ৪ সদস্যের সাব কমিটি কাজ করছে। এই সাবকমিটি শিগগিরই এ সংক্রান্ত রিপোর্ট দাখিল করবে বলে আশা করা যায়। ওই রিপোর্ট যাচাই-বাছাই শেষে চিহ্নিত অনিয়মগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদেশ থেকে ২৫ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে বলে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী সংসদে জানান, জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ডিসেম্বর ২০১০ পর্যন্ত দুই বছরে ভারত, জাপান, কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রিটিশ ভার্জিন আইসল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের ৩১৪টি প্রতিষ্ঠান উপরোক্ত অর্থ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর অর্থাত্ ২০০৭ ও ২০০৮ সালে মোট ২২ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে বলে প্রধানমন্ত্রী জানান

নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি : খুলনায় ঠিকাদার ব্যবসায়ীরা বিপাকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা

খুলনা অফিস

নির্মাণ সামগ্রীর লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে খুলনা অঞ্চলে নির্মাণ কাজসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এক মাসের ব্যবধানে সব ধরনের উপকরণের দাম ২০ থেকে ২৫ ভাগ বেড়েছে বলে মার্কেট ঘুরে জানা গেছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রড ও বিটুমিনের দাম। এক শ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়াচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের তত্পরতা রুখতে প্রয়োজনীয় সরকারি উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা মনে করছেন।
সূত্র জানায়, নির্মাণ কাজের অন্যতম প্রধান উপকরণ রডের দাম গত দুই মাসে তিন দফা বেড়েছে। খুলনার বিভিন্ন বাজারে ৬০ গ্রেডের রড প্রতিটন বিক্রি হচ্ছে ৫৯ থেকে ৬০ হাজার টাকা। ৪০ গ্রেডের রড প্রতিটন ৫১ থেকে ৫২ হাজার টাকা। মাসখানেক আগেও ৬০ গ্রেড রড ৫১ হাজার ও ৪০ গ্রেড রড ৩৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। রডের পাশাপাশি বাজারে বেড়েছে সিমেন্টের দামও। কোম্পানিভেদে প্রতিবস্তা সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগে এ দর ছিল বস্তাপ্রতি ৩১৫ থেকে ৩২০ টাকা। নির্মাণ কাজে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বিটুমিনের দাম বেড়েছে ব্যারেলপ্রতি ১ হাজার থেকে ১২শ’ টাকা। প্রতি ব্যারেল অর্থাত্ দেড়শ’ কেজি বিটুমিনের আগের দাম ছিল ৬ হাজার ১০০ থেকে ৬ হাজার ২০০ টাকা।
বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার ৩শ’ টাকায়। বালুর দামও বেড়েছে কয়েকদফা। খুলনার বাজারে ৪ ধরনের বালু পাওয়া যায়। মোটা বালু, কুষ্টিয়ার বালু, সিলেট বালু ও ধুলা বালু। এসব বালু ফুট প্রতি এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। গত মাসে সিলেট বালু ফুটপ্রতি বিক্রি হয়েছে ২৪ থেকে ২৫ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ২৯ টাকায়। পাথর প্রতি ফুট এক মাস আগেও বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৪ টাকায়। পলিথিনের এক মাস আগের দর ছিল প্রতি কেজি ৯০ টাকা, এখন তা ১১১ টাকা। ইটের দামও একই সময়ের ব্যবধানে প্রতি হাজারে ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
রডের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে স্টিল রি-রোলিং মিল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কাঁচামালের অভাবে রডের দাম বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এ কারণে রডের দাম আগামীতে আরও বাড়তে পারে। তবে সাধারণ ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, কাঁচামাল সঙ্কটের কারণে রডের মূল্য বেড়েছে—এ কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দেশে স্ক্র্যাপ ও ফিনিশড রড আমদানির ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিছু স্টিল রি-রোলিং মিল মালিক ও আমদানিকারকদের একটি সিন্ডিকেট কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে রডের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় খুলনা অঞ্চলের বিভিন্ন নির্মাণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সাধারণ ঠিকাদাররা জানান, বিভিন্ন টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে প্রতিযোগিতামূলক দরে তারা বিভিন্ন নির্মাণ ও সংস্কার কাজের ঠিকাদারি পেয়ে থাকেন। হঠাত্ করে নির্মাণ সামগ্রীর দাম কয়েকদফা বেড়ে যাওয়ায় তারা এখন আর্থিকভাবে লোকসানের মুখোমুখি রয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে কাজ বন্ধ রাখতেও বাধ্য হচ্ছেন। শুধু ঘরবাড়ি ও ভবন তৈরি নয়, রাস্তা, পুল, সেতুসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজে ব্যাপকভাবে লোহার রড ও সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়। তাই সিমেন্ট ও রডের দাম বাড়লে এসব কাজে স্বাভাবিকভাবেই বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। সামগ্রিকভাবে সব নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এ অবস্থায় নির্মাণকাজ চালিয়ে যাওয়া খুবই দুরূহ হয়ে পড়েছে। অনুরূপ কথা বলেছেন খুলনার কয়েকজন আবাসন ব্যবসায়ী। নির্মাণ সামগ্রীর দাম অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় তারা সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।